যেভাবে প্রযুক্তি দুনিয়ার শীর্ষে এলেন ইলন মাস্ক
প্রযুক্তি দুনিয়ার বস। বিশ্বের শীর্ষ ধনী। বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান টেসলা মোটরস ও মহাকাশ ভ্রমণ সংস্থা স্পেসএক্সের সিইও। টেসলা, পেপ্যালসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার নাম। তিনি ইলন মাস্ক। তিনি ২০৫০ সালের মধ্যে মঙ্গল গ্রহে একটি পরিপূর্ণ শহর স্থাপনের পরিকল্পনা করেছেন।
ছোটবেলা থেকেই ইলন ছিলেন শান্তশিষ্ট প্রকৃতির। তিনি এতটাই শান্ত ছিলেন যে, বাবা-মা তাকে বধির ভেবেছিলেন। সেই ইলন কি-না এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী। কীভাবে তিনি সফল হলেন? এ প্রশ্ন সবার মনেই। এ বিষয়ে ইলন সিবিএসের এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি অনেকবার ব্যর্থ হয়েছি, কিন্তু হাল ছাড়িনি। সবচেয়ে বড় কথা, আমি কখনো হার মানিনি আর মানবোও না। শুধু মৃত্যু এলে কিংবা অক্ষম হলে তবেই হার মানবো।’
ইলন মাস্কের জন্ম ১৯৭১ সালের ২৮ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায়। তার মায়ের নাম মায়া মাস্ক, যিনি পেশায় একজন নামকরা মডেল। তার বাবার নাম এরল মাস্ক, যিনি একজন প্রকৌশলী, বৈমানিক, নাবিক, পরামর্শক এবং প্রপার্টি ডেভেলপার। ইলন মাস্কের ছোট ভাইয়ের নাম কিম্বল এবং ছোট বোনের নাম টসকা।
১৯৮০ সালে ইলনের বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর থেকে ইলন তার বাবাকে অপছন্দ করা শুরু করেন। এখনো পর্যন্ত তিনি তার বাবাকে ‘খারাপ মানুষ’ বলেই অভিহিত করেন। ইলন মাস্কের একজন সৎ ভাই ও সৎ বোন আছেন।
ছোটবেলা থেকে ইলন ছিলেন শান্ত প্রকৃতির। এ কারণে তার বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যাও ছিল হাতেগোনা। স্কুলে মাঝে মাঝেই তিনি বুলিংয়ের শিকার হতেন। যেহেতু তিনি কোনো প্রতিবাদ করতেন না, তাই সহপাঠীরা তার সঙ্গে মজা করতেন। একবার তো একদল ছেলে তাকে সিঁড়ি থেকে ফেলে দেয়। এরপর গুরুতর আহত হন ইলন, হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। তিনি ওয়াটারক্লুফ হাউস প্রিপারেটরি স্কুল এবং ব্রায়ানস্টোন হাই স্কুলে লেখাপড়া করতেন।
ছোটবেলা থেকেই ইলনের একটি ভালো গুণ ছিল, তিনি বই পড়তে ভালোবাসতেন। ১০ বছর বয়সে কমোডর ভিআইসি-২০ কম্পিউটার ব্যবহার করতে গিয়ে কম্পিউটারের ওপর তার আগ্রহ জন্মায়। তিনি একটি ব্যবহার নির্দেশিকা অনুসরণ করে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি বেসিক প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে একটি ভিডিও গেম তৈরি করেন। গেমটির নাম ছিল ব্লাস্টার। গেমটি ৫০০ ডলারে পিসি অ্যান্ড অফিস টেকনোলজি ম্যাগাজিনের কাছে বিক্রি করে দেন।
ইলন মাস্ক সম্পর্কিত কিছু অজানা তথ্য জেনে নিন-
>> হাই স্কুল শেষে মা আর ভাই-বোন নিয়ে কানাডায় চলে যান মাস্ক। সেখানে ওন্টারিওর কুইনস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও দু’বছর পর চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে পদার্থ আর অর্থনীতিতে স্নাতক শেষ করেন। স্নাতকোত্তর শেষে পিএইচডির জন্য স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু ব্যবসায়িক ক্যারিয়ার ধরে রাখতে গিয়ে তা আর শেষ করতে পারেননি।
>> ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ইলনের মোট সম্পদ ছিল ২৪.৬ বিলিয়ন ডলার। তিনি জিপ২ (তার ওয়েব সফটওয়্যার সংস্থা) ৩৪০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করেছিলেন। এ চুক্তির জন্য ২২ মিলিয়ন ডলার পেয়েছিলেন। ২০১২ সালে ৪০ বছর বয়সে ইলনের মূল সম্পত্তি ২ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছায়। ফোর্বস ম্যাগাজিনে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনীর তালিকায় ইলনের নাম যুক্ত হয়।
>> ২০০২ সালে ইলন মাস্ক স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজিস প্রতিষ্ঠা করেন। এটি স্পেস-এক্স হিসেবে বেশি পরিচিত। এরপর ২০০৬ সালে তার সংস্থা ফ্যালকন-১, ২০১০ সালে ফ্যালকন-৯ তৈরি করে বিশ্বকে চমকে দেন। তার প্রতিটি রকেটই সফলতার সঙ্গে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।
>> বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠিয়েছে ইলন মাস্কের কোম্পানি স্পেস-এক্স। তাদের সর্বশেষ আধুনিক ফ্যালকন রকেটের মাধ্যমে ২০১৮ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধু-১ টেলিকম স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানো হয়।
>> টেসলা প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৩ সালে। তখন প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ছিলেন না মাস্ক। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে ইলন মাস্ক বোর্ড অব ডিরেক্টরসে যোগ দিলে গাড়ি কোম্পানির আমূল পরিবর্তন ঘটে। বর্তমানে বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী এবং পণ্য প্রকৌশলী ইলন মাস্ক।
>> ৭০০ কোটি ডলার থেকে বর্তমানে তার সম্পত্তির পরিমাণ ১২ হাজার ৭৯০ কোটি ডলার। ২০২০ সালে ১০ হাজার কোটি ডলার সম্পত্তি বেড়েছে মাস্কের। গতবছরের শেষে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ২০২০ সালে টেসলার শেয়ারের দর বেড়েছে উল্কার গতিতে। তাই বিল গেটসকেও টপকে গেছেন তিনি।
>> এটিই সম্ভবত ইতিহাসের দ্রুততম সম্পদ মজুদ। একবছরে ইলন মাস্কের মোট সম্পদ ১৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বেড়েছে। তার এ অর্জনের পেছনে ছিল টেসলার শেয়ার মূল্যের অভূতপূর্ব উত্থান। ধারাবাহিক মুনাফার ফলে টেসলার শেয়ার গতবছর ৭৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। টেসলা গতবছরে মাত্র অর্ধ-মিলিয়ন গাড়ি উৎপাদন করেছিল। যা ফোর্ড মোটর কোম্পানি ও জেনারেল মোটর কোম্পানির উৎপাদনের একাংশ।
>> বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনী ইলন মাস্ক কোম্পানির সিইও হিসেবে বছরে বেতন নেন মাত্র এক ডলার। নিজের অংশীদারিত্ব থাকা বিভিন্ন কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশসহ আরও কিছু সুবিধা পান মাস্ক, যার বেশিরভাগই আসে টেসলা থেকে। বছরে ১ ডলার বেতন নেওয়াটা আসলে সিলিকন ভ্যালির একটা ট্রেন্ড।
>> বরাবরই ব্যক্তিজীবনে খুব একটা সুখী নন ইলন মাস্ক। ২০০০ সালে তিনি বিয়ে করেন কানাডিয়ান লেখিকা জাস্টিনকে। তাদের বিচ্ছেদ হয় ২০০৮ সালে। সেই ঘরে তার ছেলে-মেয়ে আছে। এরপর ২০১০ সালে বিয়ে করেন অভিনেত্রী তালুলাহ রিলেয়কে। বিচ্ছেদ হয়ে যায় ২০১২ সালে। আবার তাকেই বিয়ে করেন ২০১৩ সালে। আবারো বিচ্ছেদ হয় ২০১৬ সালে। ২০১৮ সালে সম্পর্কে জড়ান সংগীতশিল্পী গ্রিমসের সঙ্গে। তাদের ঘরে একটি ছেলে আছে।
>> ইলনের প্রথম সন্তান নেভাদা ১০ সপ্তাহ বয়সেই মারা যায়। এতে ইলন বেশ মর্মাহত হয়ে পড়েছিলেন। বর্তমানে অবশ্য ৬ ছেলের বাবা ইলন মাস্ক।