অতিরিক্ত রূপচর্চাই কাল হয় রানি এলিজাবেথের
যুগে যুগে নারীরা সৌন্দর্য চর্চায় মন দিয়েছেন। ইতিহাস ঘাটলেই ক্লিওপেট্রা, এলিজাবেথ, মেরিসহ বিখ্যাত নারীর কথা সামনে আসে। তারা তাদের ক্ষমতা দিয়েই নয়, বরং সৌন্দর্যের জন্যই বিখ্যাত হয়ে আছেন। তাদের রূপের রহস্য নিয়ে ইতিহাসে আছে নানা বিতর্ক।
অনেকেই বলেন, মিশরের ফারাও রানি ক্লিওপেট্রা সৌন্দর্য ধরে রাখতে গোসল করতেন দুধ দিয়ে। উত্তর ইতালির রানি ছিলেন সিমোনেত্তা ভেসপুচ্চি। তিনি চেহারাকে ধূসর, সাদা ও আরও সুন্দর করে তুলতে মুখে জোঁক লাগিয়ে রাখতেন। জোঁকেরা মুখ থেকে রক্ত চুষে নিতো। ফলে রক্তহীনতায় মুখ হয়ে যেত ফ্যাকাশে। আর এটাই ছিল সে সময়কার নারীদের ফর্সা হওয়ার সহস্য।
যারা জোঁক ব্যবহারে আগ্রহী ছিলেন না, তারা পাউরুটির টুকরো, ডিমের সাদা অংশ ও ভিনেগার একত্রে মিশিয়ে ফেস মাস্ক হিসেবে ব্যবহার করতেন। জন্মগতভাবেই ভেসপুচ্চি ছিলেন স্বর্ণকেশী। তার মতো চুলের রং করতে নারীরা নিজের মূত্র ব্যবহার করতেন।
নিজেদের সৌন্দর্য দিয়ে আজো বিশ্ববাসীকে আকর্ষিত করছেন এই নারীরা। একুশ শতকেও তেমনভাবেই চলছে সৌন্দর্যচর্চা। বর্তমানে কসমেটিক্স ব্যবহার করেন না এমন নারী খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। এজন্য মাসে হাজার হাজার টাকা ও সময় ব্যয় করছেন।
প্রতিবছর মেকআপ এবং পারফিউম শিল্পের আয় বিশ্বে কয়েক বিলিয়ন ডলার। তবে এতসব পণ্য ব্যবহার করে সুন্দর হচ্ছেন ঠিকই, এর বিপরীতও ঘটছে। কখনো কখনো রূপচর্চাও ঘাতক হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে ক্যানসারের মতো দূরারোগ্য রোগও হতে পারে প্রসাধনীর ব্যবহারে।
তবে এটি নতুন নয়, প্রসাধনী ব্যবহারের কুফল অতীতে ঘটেছে। চারশো বছর আগেই রূপচর্চার কারণে মারা যান রানি প্রথম এলিজাবেথ। নিখুঁত মেকআপের বহরই ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল রানিকে। এ তথ্য একেবারেই মনগড়া নয়। চিকিৎসক এবং ঐতিহাসিকদের বিশ্লেষণই ইঙ্গিত দেয় এমনটার।
রানি প্রথম এলিজাবেথের যে কোনো তৈলচিত্রের দিকে তাকালেই একটি বিষয় নজরে পড়বে আপনার। রানির ছবিগুলোই বলে দেবে ত্বক, ঠোঁট এবং চুলের জেল্লা বজায় রাখতে নিয়মিত প্রসাধনীর ব্যবহার করতেন তিনি। যা তৎকালীন সময়ের অন্য নারীদের ছবিতে দেখা যায় না।
১৯৭০ সালে ইতিহাসবিদ স্যর রয় স্ট্রং রানির এই রূপচর্চাকে বর্ণনা করেছেন ‘মাস্ক অফ ইয়ুথ’ শব্দবন্ধের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তার ছবিতে। জেল্লা বজায় থাকলেও, ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে যেতে থাকে রানির ত্বক। এটা শুধু বয়সের কারণে নয়। চিকিৎসকদের অভিমত, মাত্রাতিরিক্ত প্রসাধনীর ব্যবহারের ফলেই শরীরের রং ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল তার।
১৫৫৮ থেকে ১৬০৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সাড়ে চার দশক ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং আয়ারল্যান্ড জুড়ে বিরাট সাম্রাজ্যের রাজত্ব করেছেন প্রথম এলিজাবেথ। স্বভাবতই রূপ এবং আচার-আচরণে ইংল্যান্ডের সর্বোত্তম সংস্কৃতি এবং রাজকীয়তার প্রতিফলন প্রয়োজন ছিল তার। সিংহাসনে বসার পর থেকেই তাই রূপচর্চা নিয়ে বেশ সচেতন ছিলেন রানি এলিজাবেথ। দিনের নির্দিষ্ট একটি সময় তিনি ব্যয় করতেন রূপচর্চায়। তবে সে সময়ও কম ছিল না। বলা যায় দিনের বেশিরভাগ সময়ই কেটে যেত রূপচর্চায়।
তবে তার প্রসাধনী ব্যবহারের মাত্রা ছাড়ায় ষোড়শ শতাব্দীর ষাটের দশকে। ১৫৬২ সালে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিলেন রানি এলিজাবেথ। জীবন বাঁচলেও ঘাতক রোগ ছাপ রেখে গিয়েছিল তার সারা শরীরে। মুখে এবং গলায় তৈরি হয়েছিল গভীর ক্ষতদাগ। এই দাগ ঢাকতেই ‘ভেনেশিয়ান সেরুজ’-এর ব্যবহার শুরু করেন এলিজাবেথ।
সেসময় নারীদের ফর্সা হওয়ার অন্যতম প্রসাধনী ছিল এটি। মূলত সীসা এবং ভিনিগারের সংমিশ্রণে তৈরি হত এই প্রাচীন প্রসাধনী। তৎকালীন বেশ কিছু নথি থেকেও জানা যায় প্রায় আধ ইঞ্চি পুরু মেকআপ ব্যবহার করতেন রানি। তাও কয়েক ঘণ্টার জন্য নয়, সকাল থেকে শুরু করে রাত্রি পর্যন্ত একাধিকবার মেকআপের পরত পড়ত তার ত্বকে। প্রতিবার মেকআপের আগে তিনি শরীরের বাইরে প্রদর্শিত প্রতিটি অংশ ভেনেশিয়ান সেরুজ মেখে নিতেন।
এত পরিমাণ সীসা ব্যবহারই কাল হয়েছিল রানি এলিজাবেথের। তবে সীসাই একমাত্র বিপদের কারণ ছিল না রানির। মেকআপ মুছে ফেলার পর ডিমের খোসা, অ্যালাম এবং পারদের মিশ্রণ ব্যবহার করতেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই বিষক্রিয়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল পারদও।
সীসা ও পারদের তৈরি পণ্যের ব্যবহারে শুধু শারীরিক ক্ষতিই নয়, স্মৃতিভ্রংশ, বিষণ্ণতা, ইরিটেবিলিটির মতো মানসিক সমস্যার জন্য দায়ী। পারদের প্রভাবে চুলও ঝরে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দৃষ্টিশক্তি এবং ত্বকও। সেসময় এগুলো কেউ জানতেন না। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এলিজাবেথের এই সব সমস্যাই দেখা দিয়েছিল। সব চুল ঝরে গিয়েছিল তার। এজন্য পরচুলা পরতেন তিনি।
তবে এলিজাবেথের মৃত্যুর এসব কারণ নিয়ে রয়েছে অনেক বিতর্ক। ২০১৩ সালে মার্কিন লেখক স্টিভ বেরি দাবি করেন এলিজাবেথ আদতে ছিলেন পুরুষ। রাজকন্যা এলিজাবেথ মারা গিয়েছিলেন কিশোরী অবস্থাতেই।
তবে রাজার থেকে এই সংবাদ লুকাতে গ্রামের এক ছেলেকেই এলিজাবেথ সাজিয়েছিলেন অষ্টম হেনরির দুই কর্মচারী ক্যাটস এবং টমাস। আজীবন তিনিই মেকআপের আড়ালে থেকে রানির ভূমিকা পালন করে গেছেন। বিয়েও করেননি এই কারণে। এই লোককথা বেশ প্রচলিত কটসওল্ডেও। সেখানেই নাকি প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল কিশোরী এলিজাবেথের।
সূত্র: হিস্টোরি অব ইয়েস্টারডে/ মিরর