সালমা খানকে নিয়ে ড. ইউনূসের আবেগঘন স্ট্যাটাস
মুহাম্মদ ইউনূস
সালমার সঙ্গে ৭২ সাল থেকে পরিচয় এবং একসঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার শুরু। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যোগদানের দিন থেকে। সালমাও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। তার স্বামী রাণু ভাইয়ের সঙ্গে এবং তার ভাই জামিল চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় আরও আগে থেকে। নানা কর্মসূচি নিচ্ছিলাম অর্থনীতি বিভাগকে প্রাণচঞ্চল করার জন্য। সালমার সব বিষয়ে উৎসাহ। তার বাসায় নাস্তাপানির প্রণোদনা বরাবর আমাদের একত্র করতে নিশ্চিতভাবে সাহায্য করে গেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আমি চলে গেলাম টাংগাইলে ৭৮ সালে। গ্রামীণ ব্যাংকের টাংগাইল পর্ব শেষ করে যখন ঢাকায় আসলাম ততদিনে সালমারাও ঢাকায় চলে এসেছে। ঢাকায় এখন শুধু একা সালমা নয় তার পুরো পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম। সালমা নাজমা আমার বিয়ে নিয়ে মেতে পড়লো।
সালমা-রাণু খানের বাসা হয়ে উঠলো আমাদের স্থায়ী বৈঠকখানা।
সালমা এরই মধ্যে নানাদিকে নিজেকে বিস্তৃত করতে আরম্ভ করেছে। বিশেষ করে নারী আন্দোলনে। তার কদর সবার কাছে। সালমা স্পষ্টভাষী। কারো মন যুগিয়ে কথা বলার অভ্যাস তার কখনো হয়নি। তার পক্ষের যুক্তিগুলো তৈরি থাকতো জোরালোভাবে। কাজেই পিছু হটতেন না তিনি। নারী আন্দোলন তখন সবেমাত্র দানা বাঁধছে। সালমার সতেজ বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বে এই আন্দোলন বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছে। সালমা কথায় এবং যুক্তিতে যেকোনো আলোচনা তার পক্ষে নিয়ে আসতে পারতো। যেকোনো সভায় বাংলা ইংরেজি যেকোনো ভাষায় যুক্তিবহুল বক্তব্য রাখার জন্য সালমার জুড়ি ছিল না। আমাদের কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলন হতো না সালমাকে সভাপতিত্ব করতে রাজি না করিয়ে।
সিডোকে নিয়ে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করেছেন যাতে মহিলাদের জন্য সত্যিকার একটা বিশ্ব চার্টার তৈরি করে দিতে পারেন। বিশ্ব পরিমণ্ডলে গিয়ে তিনি হারিয়ে তো যানইনি, বরং তিনি তার প্রতিভার উপযুক্ত সত্যিকার কর্মক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছিলেন। এমন এমন বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনায় বসে যেতেন যেগুলো কীভাবে সমাধান করবেন তা আমার মাথায় আসতো না। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। সমাধান তার চাইই।
পত্রপত্রিকায় লেখার ব্যাপারেও তিনি একপায়ে খাড়া। শুধু লেখার জন্য লেখা না। তার বক্তব্য তিনি তুলে ধরবেনই। তা জোরালোভাবেই তুলেছেন।
আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ তার খুবই পছন্দের ছিল। আমরা তাকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বোর্ডের সদস্য করে নিয়েছিলাম। তিনি কোনো বোর্ড মিটিংয়ে অনুপস্থিত থাকতেন না। বরং আগে থেকে খোজ নিতেন কোনটার মিটিং কখন হবে যাতে তিনি নিজের প্রোগ্রাম সেভাবে করে নিতে পারেন। তার অসুখের জন্য গত কিছুদিন তিনি মিটিংয়ে থাকতে পারছেন না বলে বারে বারে আমাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে গেছেন। কিন্তু এতো কিছু সত্বেও বন্ধু পরিচর্যায় তিনি ক্ষান্তি দেননি। আমরা নিয়মিতরা তো বটেই, বরং নতুন প্রজন্মের বন্ধুরাও এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে। বাসায় না গেলে আমার বাসায় তার অপূর্ব স্বাদের কেক পাঠিয়ে মনে করিয়ে দিতেন যে কেন অনেক দিন গেলাম না।
সেই সালমা এখন তুমি একেবারেই আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলে।
এটা মেনে নেবো কীভাবে।
(ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ফেসবুক স্ট্যাটাস)