জজমিয়া রেশমা মজনু ও জনঅনাস্থা

0

সরকার সংশ্লিষ্টরা যা কিছু বলেন, যা কিছু করেন তার সবই কি খারাপ? নিশ্চয়ই খারাপের মধ্যেও কিছু ভালো ও গ্রহণযোগ্য কথা, কাজ আছে তাদের? কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ তাদের অনেক কথা বা কাজকেই ভালোভাবে নিচ্ছেন না কেন? সব কিছুতেই অবিশ্বাস, অনাস্থা কেন? সরকারের লোকজন ভালো বললেও মানুষ হাসে, ভালো কাজ করলেও মানুষ তাকে নাটক ভাবে। আর নাটককে বিনোদনের উপাদান হিসেবে নিয়ে ট্রল করে।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। এই সরকারের সাম্প্রতিক কালের উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মধ্যে একটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় একদিনের মধ্যে ধর্ষককে পাকড়াও করা। শক্তিশালী ক্লু ছাড়া এমন একটি ধর্ষণের ঘটনায় এত দ্রুত ধর্ষককে ধরে ফেলা কত বড় কৃতিত্বের কাজ! কিন্তু মানুষ যেন সেই কৃতিত্বটা কিছুতেই দিতে চায় না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। বিশেষ করে ‘ধর্ষক মজনু’র ছবি দেখার পর পত্রিকায় প্রকাশিত ধর্ষণের ঘটনা মিলিয়ে দেখে অনেকেই বলা শুরু করলেন, এই নেশাখোর ক্ষয়ে যাওয়া শরীরের মজনুকে একটা বাচ্চা মেয়ে কনুই দিয়ে জুঁতসই একটা গুঁতা মারলেও সে পড়ে যাওয়ার কথা। সেই নেশাসক্ত টলটলায়মান মজনু কেমনে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শক্ত মনের একটি মেয়েকে একা রাস্তা থেকে তুলে ঝোপের আড়ালে নিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করে!

এ সন্দেহ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, মানুষকে বিশ্বাস করানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করতে পারেনি সরকার। মজনুই যে প্রকৃত ধর্ষক তা প্রমাণের জন্য সরকার সমর্থক সুশীল ও পেশাজীবীদের টিভি চ্যানেলে ঘুরে ঘুরে বলতে হয়েছে যে মেয়েটিই এই ধর্ষককে শনাক্ত করেছে। শুধু সাধারণ মানুষই নন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর বলেছেন, ধর্ষক মজনু গ্রেপ্তারের ঘটনায় মানুষের মধ্যে স্বস্তির বদলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি কতটুকু অনাস্থা থাকলে, মানুষ অপরাধীকে ধরা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারে। মানুষ প্রশ্ন তুলেছে এই কি আসল ধর্ষক নাকি ‘জজ মিয়া নাটক’।

ডাকসু ভিপি ‘জজ মিয়া’র কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষক আসিফ নজরুল মনে করিয়ে দিয়েছেন রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে উদ্ধার করা রেশমার কথা। তিনি বলেছেন, ‘অভিযোগ রয়েছে যে রেশমা উদ্ধার নাটক করা হয়েছিল হেফাজতের সমাবেশে হামলাকে আড়াল করার জন্য। তারপর দিনে দিনে মিথ্যার পাহাড় এত উঁচু হয়েছে যে সত্য কথা বললেও মানুষ আর বিশ্বাস করে না তাদের। ধর্ষণের অভিযোগে মজনু গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে তা আবার দেখা গেল (দৈনিক যুগান্তর, ১১ জানুয়ারি ২০২০)।

অনেকেরই হয়তো মনে আছে, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভারে আট তলা রানা প্লাজা ভেঙে পড়ে ১১শ’র বেশি পোশাক শ্রমিক নিহত হন। আহত হন বহু মানুষ। ওই সময় রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ  থেকে ১৭ দিন পর পোশাককর্মী রেশমা বেগমকে উদ্ধারের ঘটনাটিকে সাজানো নাটক বলে জানায় যুক্তরাজ্যের ট্যাবলয়েড মিরর। সাইমন রাইটের লেখা মিরর-এর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৭ দিন পর পোশাককর্মী রেশমা বেগমকে উদ্ধারের ঘটনাটি ছিল সাজানো নাটক। রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় রেশমার সঙ্গে কাজ করতেন এমন একজন পুরুষ কর্মী জানিয়েছেন ভবন ধসে পড়ার পর ওই দিনই তিনি এবং রেশমা একসঙ্গে ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে আসেন। ওই সহকর্মী বলেন, ‘আমরা দুজন একসঙ্গেই হেঁটে ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে আসি। এরপর দুদিন একই হাসপাতালে চিকৎসাধীন ছিলাম। এরপর রেশমা উধাও হয়ে যান। ১৭ দিন পর তাকে দেখলাম  টেলিভিশনে। তারা এটাকে অলৌকিক ঘটনা বলে জানাল। কিন্তু এটা ছিল ধোঁকাবাজি।’ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রেশমা যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন ওই বাড়ির কর্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর ওই দিনই রেশমাকে উদ্ধার করা হয়। এরপর পাশের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নেন। এই রিপোর্টটির বিস্তারিত তুলে ধরতে হলো। কারণ এতদিনে অনেকেই হয়তো ভুলে  গেছেন সেই রেশমা কাহিনী।

এই যে আস্থার সংকট, তা একদিনে তৈরি হয়নি। বহু ঘটনায় দিনে দিনে ভারী হয়েছে জনঅনাস্থার এ বোঝা। একের পর এক বন্দুকযুদ্ধের নামে যে মানুষগুলোকে মারা হয়েছে, আর যে বিবরণ সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয়েছে, তা কি বিশ্বাস করেছে মানুষ? অপহরণের পরে যারা ফিরে এসেছেন তাদের যে সরকারি বাহিনী নেয়নি তা বোঝানোর জন্য যে গল্পগুলো বাজারে ছাড়া হয়েছে বিভিন্ন সময় তা কি বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে মানুষের মাঝে? বিএনপি নেতা সালাহউদ্দীন আহমেদ, লেখক চিন্তক ফরহাদ মজহার, বিশ্বদ্যিালয় শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান সিজার, সাংবাদিক উৎপলসহ অনেকেই যারা অপহণের পর আবার ফিরে আসতে পেরেছেন তাদের বিষয়ে যে গল্প বাজারে ছাড়া হয়েছিল তা কি কেউ বিশ্বাস করেছে?

বিরোধী দলকে কোণঠাসা করতে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের পর যে নাশকতার গল্প তৈরি করা হয় তার কতটা সত্য আর কতটা মিথ্যা তা নিয়েও জনমনে আছে ব্যাপক অবিশ্বাস। এভাবে একটা ইস্যুকে আরেকটা ইস্যু দিয়ে ঢাকার যে প্রবণতা দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, তা তাদের প্রতি মানুষের অনাস্থা বাড়াতে সাহায্য করেছে। যতই ইস্যু দিয়ে ইস্যু ঢাকা হোক, যতই নাটক প্রযোজনা করা হোক, তা দিয়ে যে পরিস্থিতি ঢেকে রাখা যায় না তা স্পষ্ট। দেশের পরিস্থিতি সব দিক থেকেই ভয়াবহ। অবস্থা যে কতটা ভয়াবহ তা ধর্ষণরোধে জাতীয় সংসদে দেওয়া জাতীয় পার্টির দুজন এমপির বক্তব্য ও তার সমর্থনে দেওয়া সরকারি দলের একজন ও অপর দলের একজন এমপির বক্তব্য শুনলেই বোঝা যায়। একটা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, আইনের শাসন ও বিচারহীনতা কতটা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়লে জাতীয় সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের এমপিরা সমস্বরে বিচারবহির্ভূত হত্যার আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করেন?

জাতীয় সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক বলেন, যে হারে ধর্ষণ বেড়েছে, সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়ে তা ‘কন্ট্রোল’ হচ্ছে না। অনুরোধ থাকবে ধর্ষণের দায়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলব, আপনার সরকার, মন্ত্রণালয়ে এত ঘটনা ঘটছে মাদকের জন্য, এত ক্রসফায়ার হচ্ছে, সমানে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ, জঘন্য ঘটনার জন্য কেন একটাও বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়নি, আমি জানি না। ধর্ষণ নিয়ে সারা দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। নারীসমাজ উদ্বিগ্ন। পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২০১৯ সালে।

আর জাতীয় পার্টির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ এ বিষয়ে বলেন, ‘এই মুহূর্তে সমাজকে ধর্ষণমুক্ত করতে হলে ‘এনকাউন্টার মাস্ট’। ধর্ষককে গুলি করে মারতে হবে। একমাত্র ওষুধ পুলিশ ধরার পর ধর্ষককে গুলি করে মেরে ফেলা। সাম্প্রতিককালে ধর্ষণ মহামারী রূপ নিয়েছে। ছাত্রী, শিশু, নারী শ্রমিক, প্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। কেউ রক্ষা পাচ্ছেন না। ধর্ষণের ঘটনায় বিচার হয় ১৫ থেকে ২০ বছর পর। মানুষ এটা মনে রাখে না। শাজনীন হত্যার পর ১৬ বছর লেগেছে সেই একটি বিচার করতে। শাজনীনের বাবা এ  দেশের স্বনামধন্য একজন শিল্পপতি। তার মেয়ের এই ধর্ষণ হত্যার বিচার নিয়ে কোর্টকাছারি করতে করতে ১৬ বছর পার করছেন। একজনের মাত্র ফাঁসি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা প্রসঙ্গে কাজী ফিরোজ বলেন, ‘ধর্ষণকারী ধরা পড়েছে। ওই ছাত্রী তাকে শনাক্ত করেছেন। ধর্ষক পুলিশের কাছে আছে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারা হোক। এই মুহূর্তে যদি এই সমাজকে ধর্ষণমুক্ত করতে চান, তাহলে এনকাউন্টার মাস্ট। তাকে গুলি করে মারতে হবে। এখান থেকে এই  মেসেজটা দিতে চাই, আর কোনো ধর্ষক যেন সাহস না পায়। কারও যদি ফাঁসি হয়, কেউ খবর রাখে না। এখনই যদি এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ, তিন সপ্তাহের মধ্যে বিচার করতে পারি, বিচার কী? একমাত্র শাস্তি এনকাউন্টারে মেরে ফেলা। ১০টা ২০টা মারা হোক, ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে।’ অন্যদিকে ক্রসফায়ার বিষয়ে ফতোয়া দিয়ে তরিকত ফেডারেশনের সাংসদ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি বলেছেন, ‘আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে বলছি, এদের (ধর্ষকদের) ক্রসফায়ার করলে  কোনো অসুবিধা নেই।’

শুধু ধর্ষণ বা নারী-শিশু নির্যাতন নয়, সব প্যারামিটারেই দেশে এক অস্বস্তিকর ভয়াবহ পতন লক্ষণীয়। সব কিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তা ঢাকতে সরকারকে একের পর এক নাটকের জন্ম দিতে হচ্ছে। আর তাতে বাড়ছে তাদের প্রতি অনাস্থা। সরকার যাবে সরকার আসবে। কিন্তু এই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়েই চলতে হবে আমাদের। তাই তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা এভাবে নষ্ট হতে থাকলে এ দেশের ভবিষ্যত যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা হয়তো আমাদের কল্পনার বাইরে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com