শিশুকে গল্প পড়ে শোনান
শিশুকে গল্পের বই পড়ে শোনালে তার ভাষা, ছন্দ, অক্ষরজ্ঞান ও বুদ্ধির বিকাশ ঘটে। এ ছাড়া শিশুর কল্পনাশক্তি ও কৌতূহল বৃদ্ধি পায়। শিশুর সঙ্গে সুন্দর সময় কাটানো যায়; অভিভাবক ও শিশু দুজনই আনন্দ অনুভব করতে পারে। শিশুর মধ্যে বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। পরবর্তী সময়ে বইপড়া কষ্টের মনে না করে আনন্দের মনে করে। শিশুদের গল্পের বই পড়ে শোনানোর কৌশল জানালেন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট তানজির আহম্মেদ তুষার
সময় নির্ধারণ
ঘুমের আগে, খাওয়ার সময়, বাসে, ট্রেনে বা কারে সব সময়ই গল্প পড়ে শোনানোর জন্য ভালো সময়। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় গল্প পড়ার অভ্যাস করতে পারেন। এতে শিশুর গল্প শোনার প্রস্তুতি থাকবে। এই অভ্যাস পরবর্তী সময়ে ক্লাসের পড়ার ক্ষেত্রেও কাজে লাগবে। গল্প পড়ে শোনানোর জন্য শান্ত পরিবেশ নির্ধারণ করুন। গল্পের প্রতি শিশুর প্রতিক্রিয়া কেমন খেয়াল করুন। জোর করে গল্প শোনাতে যাবেন না। যখন শুনতে চাইবে তখনই শোনান। মনে রাখতে হবে, শিশুদের কাছে গল্প খুবই প্রিয়, জোর করলে সেই প্রিয় বিষয়ের প্রতি তারা বিরক্ত হয়ে যেতে পারে।
গ্যাজেট থেকে দূরে
গল্প বলার সময়ে টিভি, কম্পিউটার বা ট্যাব বন্ধ রাখুন। যাতে শিশু মনোযোগ সহকারে আপনার কথা শুনতে পায়।
বসার জায়গা
গল্প পড়ে শোনানোর সময়ে শিশুকে কাছে নিয়ে বসুন যেন সে বই ও আপনার মুখ সহজেই দেখতে পায়। বসার স্থান শিশুর জন্য আরামদায়ক হতে হবে। প্রতিদিন একটি বিশেষ জায়গায় বা চেয়ারে বসে গল্প পড়ে শোনালে শিশুকে সহজেই গল্পের মধ্যে নিয়ে আসা যায়।
গল্প বাছাই
গল্পের মাধ্যমে শিশুদের সহজেই নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও শিষ্টাচার শেখানো সম্ভব। যেমন : বাঘ ও রাখালের গল্পটিতে শিশুদের মিথ্যা না বলার জন্য উৎসাহিত করা হয়। এমন ধরনের গল্প বেছে নিন যেটি শিশুর কাছে মজা লাগবে এবং সেখানে শিক্ষণীয় বার্তা থাকবে। আসলে প্রায় সব গল্পের মধ্যেই এমন বার্তা থাকে। সেটি খুঁজে শিশুর সামনে উপস্থাপন করতে হবে। গল্পটি যদি আপনার মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির না হয় তাহলে তা থেকে সে বিপরীত ধরনের মূল্যবোধ পেতে পারে; তাই সেদিকে সতর্ক থাকুন। বই পছন্দ করার সময়ে লক্ষ রাখতে হয় যেন বইটি রঙিন ও ছবিযুক্ত হয়। কিছু কিছু বই খুললে বিভিন্ন ছবি, পশু-পাখির আকৃতি যেন বই থেকে উঠে আসে এবং বইটি নাড়ালে সেগুলোও নড়ে। এ ধরনের বই শিশুরা অনেক পছন্দ করে। বই পছন্দের ক্ষেত্রে শিশুকেও সঙ্গে নিন ও তাকে পছন্দ করার সুযোগ দিন।
শিক্ষণীয় বার্তা
প্রতিটি গল্পের মধ্যে একটি শিক্ষণীয় বার্তা থাকে। অনেকে গল্প বলার সময়ে এত বেশি গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষণীয় বার্তাটি বারবার বলতে থাকেন যে শিশুটির কাছে মনে হয় বাবা/মা তাকে গল্পটি বলতে চাননি আসলে শুধু বার্তাটি দিতে চেয়েছেন। বার্তাটি তার কাছে অত্যাচারের মতো মনে হয়। ফলে শিশুটি বার্তাটি গ্রহণ তো করেই না উপরন্তু গল্পও শুনতে চায় না। তাই বার্তাটি গল্পের মধ্যেই এমন ভাবে বলুন যেন শিশু তা গল্পের অংশই মনে করে।
সুর, ছড়া, ছন্দ
শিশুরা সুর, ছন্দ ও ছড়া পছন্দ করে তাই গল্পটির মধ্যে এগুলো নিয়ে আসুন এবং গল্পটি সুর ও ছন্দ দিয়ে মজার করে উপস্থাপন করুন। তারা বিভিন্ন জিনিসের দ্বিরুক্তি পছন্দ করে। তাই তাদের গল্প বলার সময়ে দ্বিরুক্তি ব্যবহার করুন। যেমন : ‘চাঁদ বুড়ি চাঁদ বুড়ি আমার বোনকে খুঁজে দাও না দাও না’, অথবা সুর করে বলুন ‘আয়রে আয় তু তু রঙা রঙা ভুতু’ ইত্যাদি।
বই ধরা
আপনি যেভাবে বই ধরবেন বড় হয়ে সেও ওইভাবে বই ধরতে চাইবে। তাই কীভাবে বই ধরতে হয় তা শেখানোর জন্য আপনিও সুন্দর করে বই ধরুন।
শিশুর অংশগ্রহণ
গল্প পড়ে শোনানোর সময়ে মাঝে মাঝে ছবি দেখিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করুন। তবে জিজ্ঞাসাটা মোটেও শিক্ষকসুলভ নয়, বন্ধুসুলভ হতে হবে। যেমন ‘চলো তো দেখি ছবিতে কী হচ্ছে! এটা কী? ওটা কী করছে?’ এ ছাড়া বাক্য শেষ না করে এমনভাবে একটু বিরতি দিন যাতে সে বাক্যটি শেষ করতে উৎসাহিত হয়।
চরিত্র অনুযায়ী শব্দ
গল্পের চরিত্র অনুযায়ী শব্দ করুন। কোনো পশু-পাখির চরিত্র থাকলে তাদের মতো করে শব্দগুলো উচ্চারণ করুন। যেমন : ‘ছাগল বাঘকে বলছে ম্যা ম্যা বাঘ মামা বাঘ মামা আমাকে খেও না’। এতে শিশু খুবই আনন্দ পাবে এবং গল্পটি মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকবে।
একই গল্প বারবার
শিশুরা একই গল্প বারবার শুনতে পছন্দ করে। মজার ব্যাপার হলো প্রতিবারই একই রকম আগ্রহ নিয়ে তারা শুনতে পারে। এ কারণে একই গল্প তারা শুনতে চাইতে পারে। বিরক্ত না হয়ে গল্পটি প্রথমবারের মতোই মজা করে বলুন।