একটি টাকার মালামাল সরবরাহ না করেও ৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকার বিল

0

করোনাকালে হরিলুটের আরেক কাহিনি এলো সামনে

মহামারি করোনাকালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস (ইআরপিপি) প্রকল্পে করোনা রোগের চিকিৎসায় অতি প্রয়োজনীয় পিপিই, মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস সরবরাহ না করেই জাদিদ অটোমোবাইলস নামক একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকার বিল হাতিয়ে নেয়ার গুরুতর অভিযোগে উঠেছে। 

চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ৪৫ দিনের মধ্যে সমুদয় মালামাল বুঝিয়ে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি মোটা অঙ্কের টাকার বিল হাতিয়ে নিলেও গত তিন মাসে একটি টাকারও মালামাল সরবরাহ করেনি। নজীরবিহীন এ অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনার অভিযোগে এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়নি। এ যেন বাংলা প্রবাদ ‘ওলটপালট করে দে মা, লুটেপুটে খাই’ অবস্থা।

স্বাস্থ্য খাতে এর আগে ভুয়া করোনা টেস্ট ও সনদ বাণিজ্য, নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের অভিযোগ পাওয়া গেছে। করোনাকালে রিজেন্ট, জেকেজির পর নতুন এই জালিয়াতির খবর এলো।

নির্ভরযোগ্য দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, জাদিদ অটোমোবাইলস নামক প্রতিষ্ঠানটি মূলত মোটরগাড়ি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। তারপরও করোনা চিকিৎসায় ৩১ কোটি ৯০ লাখ টাকার জরুরি প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহে গত ১৯ মে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাথে তাদের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। 

চুক্তি অনুযায়ী ১৯ মে থেকে পরবর্তী ৪৫ দিনের মধ্যে ৫০ হাজার পিস পিপিই, ৫০ হাজার পিস এন৯৫ মাস্ক, ৫০ হাজার পিস কেএন ৯৫ মাস্ক এবং ১ লাখ পিস হ্যান্ড গ্লাভস সরবরাহ করার কথা ছিল । অথচ প্রতিষ্ঠানটি ৩০ জুনের আগেই তুলে নেয় ৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর থেকে জাদিদ অটোমোবাইলসের মালিক শামীমুজ্জামান কাঞ্চনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

জানা গেছে ইআরপিপি প্রকল্পের যিনি পরিচালক ছিলেন, সেই অধ্যাপক ডা. ইকবাল কবিরের (যিনি পরবর্তীতে ওএসডি হন) সঙ্গে আত্মীয়তার সুবাদেই শামীমুজ্জামান কাঞ্চন চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও কাজটি পান। এ ব্যাপারে জানতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

তারা জানান, মহামারি মোকাবেলায় জরুরি ভিত্তিতে ওই সময় প্রকল্প পরিচালকের মাধ্যমে বিভিন্ন চুক্তি হয়। এ ব্যাপারে তারা তেমন কিছুই জানতেন না। পরবর্তীতে তারা জুন মাসে অর্থবছর শেষ হওয়ার দোহাই দিয়ে সাড়ে ৯ কোটি টাকা বেশি বিল তুলে নেয়ার বিষয়টি সম্পর্কে জেনেছেন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানান, তিনি শুরু থেকেই মহামারি করোনাকালে জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী কেনাকেটা, মালামাল কাদের মাধ্যমে কেনা হচ্ছে, এগুলোর মান কেমন ইত্যাদি সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখছিলেন। ওই সময়ই তিনি জাদিদ অটোমোবাইলসের মাধ্যমে বিভিন্ন মালামাল কেনার চুক্তি হয়েছে শুনে বিস্মিত হন। পরবর্তীতে জানতে পারেন প্রতিস্টানটির মালিক মালামাল সরবরাহ না করেই ৩০ জুনের আগেই সাড়ে ৯ কোটি টাকার বেশি তুলে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে। 

এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ (১৬ আগস্ট) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সম্পর্কে ‘অভিযোগ করছি না,শাস্তি চাইছি না’ শিরোনামে ক্ষোভ প্রকাশ করে একটি ষ্ট্যাটাস দেন। তার ষ্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

‘জাদিদ অটোমোবাইলস একটি মোটরগাড়ির দোকান। স্বাস্থ্য অধিদফতর এদের সাথে চুক্তি করলো। না মোটরগাড়ি সরবরাহের চুক্তি নয়, করোনা রোগের চিকিৎসায় অতি প্রয়োজনীয় পিপিই, মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস সরবরাহের চুক্তি। কী অসাধারণ আবিষ্কার!! মোটরগাড়ির ব্যবসায়ী যেন যাদুর কৌশলে রূপান্তরিত হলো অভিজ্ঞ দায়িত্বশীল জরুরি মেডিক্যাল সামগ্রী সরবরাহকারীতে। ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস (ইআরপিপি) প্রকল্পে ৩১ কোটি ৯০ লাখ টাকার করোনা চিকিৎসায় জরুরি প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহের কাজ দেয়া হয় জাদিদ-কে। ১৯মে২০২০-এ চুক্তি সম্পাদিত হয়। ১৯মে থেকে পরবর্তী ৪৫ দিনের মধ্যে জাদিদ –৫০ হাজার পিস কভারঅল পিপিই, ৫০ হাজার পিস এন৯৫ মাস্ক, ৫০ হাজার পিস কেএন ৯৫ মাস্ক এবং ১ লাখ পিস হ্যান্ড গ্লাভস সরবরাহ করবে। এজন্য জাদিদ ৩০ জুনের আগেই তুলে নেয় ৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। আজ ১৬ আগস্ট ১০০তম দিন পেরিয়ে গেল কিন্তু জরুরি সুরক্ষা সামগ্রী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পৌঁছালোনা। ৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা তুলে নিয়ে জাদিদের মালিক শামীমুজ্জামান কাঞ্চন লাপাত্তা। মোটরগাড়ির দোকান জরুরি স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহের দায়িত্ব পেল কোন যাদুকরের হাতসাফাই-য়ে? অনেক অনেক প্রশ্ন মাথায় আসে। সুরক্ষা সামগ্রীর জন্য কতো স্বাস্থ্যকর্মি ও ডাক্তার মারা গেল, করোনায় ভুগলো। এতে কতো অসুস্থ মানুষের সেবা বিঘ্নিত হলো। একজন অভিজ্ঞ প্রশিক্ষিত ডাক্তার তৈরি করতে রাষ্ট্রকে কতো টাকা ও সময় বিনিয়োগ করতে হয়। এতোসব যাদের জন্য ঘটে, রাষ্ট্রের টাকা যারা লুট করে তারা দিব্যি ভালো থাকে। প্রশ্ন করিনা–জানি উত্তর আসবেনা——–’।

তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইআরপিপি প্রকল্পের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক ডা. ইকবাল কবির বলছেন ভিন্ন কথা। আজ ১৬ আগষ্ট জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, মালামাল সরবরাহ একেবারেই করা হয়নি এ অভিযোগ সঠিক নয়। এন-৯৫ মাস্ক ও পিপিই আংশিক সরবরাহ করা হয়েছে। আর ৯ কোটি ৫৭লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও সত্য নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মতোই ওই টাকা আগাম পরিশোধ করা হয়েছে। আর জাদিদ অটোমোবাইলসের মালিকের সঙ্গে তার কোনো প্রকার আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই বলে তিনি জোর দাবি করেন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com