রংপুর মেডিকেলে মিঠু সিন্ডিকেট: ‘ভাতিজি’র নেতৃত্বে করোনার ১শ’ কোটি টাকা লুটপাট

0

বিগত বছরগুলোতে সারাদেশের মেডিকেল কলেজ, হাসপাতালসহ স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানসমুহে ব্যাপক লুটপাট চালিয়েছে বহুল আলোচিত ঠিকাদার মিঠু সিন্ডিকেট। তারমধ্যে একটি হলো রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। প্রায় গত এক যুগ ধরেই মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু এ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটিতে একচেটিয়া লুটপাট চালাচ্ছে। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরে করোনা মোকাবেলার ১শ’ কোটি টাকার সরকারি বরাদ্দও হাতিয়ে নিয়েছে মিঠু সিন্ডিকেট। কোনোরকমের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে, এমনকি অনেক মালামাল সরবরাহ না করেও সেই বিল তুলে নেয়া হয়েছে। এতে নেতৃত্ব দেন খোদ মিঠুর আপন ভাতিঝি উম্মে সুলতানা নওশিন। মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে রয়েছেন। কিন্তু সেখানে বসেই তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। 
জানা গেছে, মিঠু বিদেশে বসেই নওশিনের স্বামী বেলাল হোসেনের নামে রংপুর মেডিকেলে সর্বশেষ সরকারি বরাদ্দের ১শ কোটি টাকা কেনাকাটার কাজ বাগিয়ে নেন। কোন রকম নিয়ম-নীতি না মেনেই কাজটি তাকে দেয়া হয়। মাস্ক, পিপিই, কিটসহ অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ দেখানো হলেও বাস্তবে অনেক মালামাল সরবরাহ না করেই বিল তুলে নেয়া হয়েছে। হাসপাতাল পরিচালকের পিএ হয়েও নওশিন ছিলেন এই টেন্ডার কমিটির সদস্য।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উম্মে সুলতানা নওশিন পরিচালকের পিএসহ মোট তিনটি পদ অধিকার করে ছিলেন। মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর গ্রামের বাড়ি রংপুরে। মিঠু-ই ভাতিঝি নওশিনকে নিজের এলাকা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক সময় কেরানির চাকরি দেন। রাতারাতি নওশিন হয়ে উঠেন এই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটির সর্বেসর্বা। সম্প্রতি দেশের স্বাস্থ্যখাতের লুটপাট নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নামও আসে। সেই প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে নওশিনকে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে বদলি করা হয়। কিন্তু লালমানিরহাট বদলি করা হলেও এখনো রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নওশিনের কর্তৃত্ব রয়ে গেছে। গত ৫ জুলাই উম্মে সুলতানা নওশিনকে লালমনিরহাট বদলি করা হয়। কিন্তু এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পরিচালকের দপ্তর ও হিসাব বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ফাইলপত্রসহ অফিসের চাবি বুঝিয়ে দেননি তিনি। এতে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কাজকর্মে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তারপরও মিঠুর ভয়ে কর্মকর্তারা তাকে কিছু বলতে পারছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উম্মে সুলতানা নওশিনের স্বামী বেলাল হোসেন ইতিপূর্বে রংপুরের আল আরাফা ব্যাংকের পায়রা চত্বর শাখায় সিনিয়র অফিসার পদে কর্মরত ছিলেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে দু’বছর আগে রংপুর মেডিকেলে মালামাল সরবরাহের কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন বেলাল হোসেন। এ ব্যাপারে কথা বলতে কয়েকবার ব্যক্তিগত ফোন নম্বরে কল করলেও ধরেননি তিনি।
স্বাস্থ্যখাতের আলোচিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু গত এক যুগ ধরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেনাকাটার নামে শত শত কোটি টাকা লুট করেছেন। তবে কাজ পেতে মিঠুকে কখনো হাসপাতালে আসতে হয়নি। সারাদেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো রংপুরেও বরাবর সিন্ডিকেটের সদস্যদের দিয়েই তিনি কাজ চালান। মিঠুকে রংপুর মেডিকেলে দেখা গিয়েছিলো সেই ২০১২ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হকের সঙ্গে। এমআরআই মেশিন উদ্বোধন করতে এসেছিলেন মন্ত্রী। এই হাসপাতালের এসি, এক্সরে মেশিন, আইসিইউ থেকে শুরু করে সিসিটিভি স্থাপন ও সাপ্লাইয়ের সব কাজ করেছেন আলোচিত এই ঠিকাদার। যদিও মেশিনপত্রগুলোর কোনোটাই এখন আর সচল নেই।
ইতিপূর্বে শিক্ষাভবন ও স্বাস্থ্য অধিদফতরে টুকটাক ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকলেও মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর উত্থান মূলত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পর। এ সময় তিনি এক পর্যায়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হকের একেবারেই ঘনিষ্ঠ, এমনকি মন্ত্রীর ছেলের বিজনেস পার্টনার হিসেবেই আবির্ভূত হন। ফলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিএমএসডিসহ অন্যান্য দফতরসমুহ পুরোপুরি তার হাতের মুঠোয় চলে আসে। প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ, টেন্ডার, এমনকি স্বাস্থ্যখাতের ডাক্তার, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ-বদলিও হতো তার ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। সেই থেকে তিনি চালিয়ে যান স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বরাদ্দের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট। লুটপাটের সুবিধার্থে সারাদেশেই ডাক্তার, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বহিরাগতের সমন্বয়ে নিজের উপসিন্ডিকেট তৈরি করেন। তার সেইসব সিন্ডিকেটই ক্রমান্বয়ে মহীরূহ হয়ে ওঠে। 
২০১৪ সালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদে পরিবর্তন হলে মিঠু সিন্ডিকেট প্রথমে কিছুদিন চুপচাপ থাকে। তারপরই খুব অল্প সময়ে আবার আগের অবস্থানে চলে আসে। একই কায়দায় চলতে থাকে সবকিছু। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বধীন আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় সরকারে নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান আগের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন। প্রতিমন্ত্রী থাকতে জাহিদ মালেকের যেহেতু সবকিছু জানাশোনাই ছিল তাই এবার আর মিঠুকে মোটেই বেগ পেতে হয়। আগের চেয়েও বীরদর্পে আবির্ভুত হন তিনি। এমনকি স্বাস্থ্য অধিদফতরের সদ্য বিদায়ী অত্যন্ত প্রভাবশালী ডিজি আবুল কালাম আজাদও ছিল বরাবর মিঠুর হাতের মুঠোয়। আর এসবেরই ফল স্বাস্থ্যখাতের আজকের বিশৃঙ্খলা ও ধ্বস। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এই টেন্ডার লুটপাটের ঘটনা সারাদেশে মিঠুর হাজার হাজার অপকর্মের একটি অংশমাত্র, বলছেন সংশ্লিষ্টরা। 

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com