করোনাকালেও অসাধু শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য

0

করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। দুর্যোগকালীন এ সময়ও বেশকিছু অসাধু শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে।

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের মতো রাজধানীর শীর্ষ মানের স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে তারা নিজ ক্লাসের শিক্ষার্থীদের বাধ্য করে কোচিংয়ে আনছেন। বিনিময়ে প্রতিজনের কাছে মাসপ্রতি ২-৫ হাজার করে টাকা আদায় করছেন। এমন অসংখ্য অভিযোগ পাওয়ার পর অনুসন্ধানে এর সত্যতা মেলে।

অভিভাবকদের দাবি, সরকারি মনিটরিং না থাকায় কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করে কোচিং নীতিমালা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন অভিভাবক সংগঠনের নেতারা।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রাজউজ উত্তরা মডেল কলেজসহ নামিদামি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে কোচিং বাণিজ্য শুরু করেছেন। এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করছেন- জুম অ্যাপস ও ফেসবুক লাইভ। নানা কৌশলে শিক্ষার্থীদের কোচিং সেন্টারের আওতায় আসতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ জানিয়েছেন অভিভাবকরা।

জানা গেছে, রাজধানীর স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মুগদা শাখার বাংলা বিষয়ের শিক্ষক গোলাম রাব্বানী গত ২০ মার্চ থেকে ফেসবুক লাইভে ও জুম অ্যাপসে তার বিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাসের দুই শতাধিক শিক্ষার্থীকে কোচিং করাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাথাপিছু মাসিক ২-৫ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে আদায় করছেন। শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি ‘কোচিং সম্রাট’ নামে পরিচিত। স্কুলের পাশে বড় একটি ফ্লাটে কোচিং করান তিনি। দুদকের খাতায়ও এই শিক্ষকের নাম রয়েছে বলে জানা গেছে।

শিক্ষার্থীদের বাধ্য করে কোচিং করানোর অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষক গোলাম রাব্বানীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার প্রয়োজনে আমি কোচিং করাই, আপনার যা ইচ্ছা লেখেন। অধ্যক্ষ ও চেয়ারম্যানকে জানিয়ে আমি কোচিং করি। প্রতি মাসে কয়েকজনকে মাসোয়ারা দেই। আমার কিছু হয় না, টাকা ঢাললেই সব ঠিক হয়ে যায়।’ তাই কাউকে ভয় পান না বলে ফোনের সংযোগ কেটে দেন এই শিক্ষক।

দেখা গেছে, আইডিয়ালের বনশ্রী শাখার ইংরেজি শিক্ষক হাবিবুর রহমান, আতিকুল, শাহজালাল ঢালী, আহমেদ খান, রসায়নের শিক্ষক জিয়াউল হক, শাখাওয়াত হোসেনসহ প্রায় ৫০ জন ফেসবুক লাইভে ও জুম অ্যাপস ব্যবহার করে কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। মোবাইল লেনদেন সেবা বিকাশ, রকেট ও নগদের মাধ্যমে অভিভাবকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করছেন।

তবে এসব শিক্ষকের অনেকে অনলাইনে কোচিং বাণিজ্যের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। দ্রুত অনলাইন প্ল্যাটফর্মে চালানো কোচিং বন্ধ করে দেবেন বলে জানিয়ে প্রতিবেদনে নাম উল্লেখ না করার অনুরোধ জানান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম বলেন, ‘আমাদের স্কুল বন্ধ হওয়ার পর থেকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শ্রেণি শিক্ষকরা লাইভ ক্লাস শুরু করেছেন। এতে প্রায় ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের কোনো কোনো শিক্ষক লাইভ ক্লাস না করিয়ে অনলাইনে নিজেরা কোচিং সেন্টার খুলে বসেছেন বলে অভিযোগ এসেছে। তার মধ্যে গোলাম রাব্বানীসহ বেশ কয়েকজন রয়েছেন। এসব শিক্ষক দিনের পর দিন নানা ধরনের অন্যায় করে গেলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। গভর্নিং বডির (জিবি) একাধিক সদস্য তাদের কাছে বাড়তি সুবিধা নিয়ে মদদ দিয়ে যাচ্ছেন।’ বিষয়টি তিনি গভর্নিং বডির চেয়ারম্যানকে জানাতে অনুরোধ করেন।

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোর্শেদ জামান বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের কাউকে কোচিং বাণিজ্য করার অনুমতি দেয়া হয়নি। কেউ যদি এমন কথা বলে তবে তাকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে।’

এদিকে, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বসুন্ধরা শাখার ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক মিল্কি, রসায়নের শিক্ষক মাহবুবুর হক মিঠু, সাবেক শিক্ষক প্রতিনিধি আবু সুফিয়ান, আছিয়া বেগম, নাইমুল, ওহিদাসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক ডিজিটাল পদ্ধতিতে কোচিং শুরু করেছেন।

এসব শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, ফেসবুক ও জুম অ্যাপে ৩০ থেকে ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে কোচিং শুরু করলেও অধ্যক্ষের নির্দেশে অনেকে তা বন্ধ করে দিয়েছেন। অন্যরাও দ্রুত বন্ধ করে দেবেন বলে জানান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভিকারুননিসার গভর্নিং বডির সদস্য পুলিশ সুপার (এসপি) বেনজীর বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির মধ্যে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যের বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ আসছে। এ পরিস্থিতিতে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব নয়। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফওজিয়া বলেন, ‘বসুন্ধরা শাখার কয়েকজন শিক্ষক কোচিং করাচ্ছেন, এমন অভিযোগ আসার পর আমার নির্দেশে দ্রুত তা বন্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক কোচিং করাচ্ছে বলে আমার কাছে অভিযোগ নেই, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এ বিষয়ে অভিভাবক ফোরামের সভাপতি জিয়াউল হক দুলু বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে কোচিং বাণিজ্য করছেন আইডিয়ালের বেশকিছু শিক্ষক। এসব সম্মানহীন শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দুদকসহ বিভিন্ন স্থানে মামলা দায়ের হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘কোচিং নীতিমালা বাস্তবায়নে আদালতের নির্দেশনা থাকলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং কমিটি না থাকায় তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।’ তাই দ্রুত একটি কমিটি গঠন করে কোচিং নীতিমালা বাস্তবায়নের দাবি জানান তিনি।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। এ সময়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা চলমান রাখতে সংসদ টেলিভিশনে শ্রেণি ক্লাস সম্প্রচার শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। এরপর প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর এবং কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য টেলিভিশন ক্লাস সম্প্রচার হয়।

জানতে চাইলে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মধ্যে অনেক শিক্ষক অনলাইনে কোচিং করাচ্ছেন বলে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। কেউ যদি বাধ্য করে কোচিং করিয়ে টাকা আদায় করে এটি মেনে নেয়া হবে না। কারও বিরুদ্ধে এমন তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com