ডিসি যখন শাসক দলের ‘চামচা’ অথবা ক্ষমতাবান ‘অত্যাচারী’

0

যদি তর্কের খাতিরে ধরেই নিই যে, কুড়িগ্রামের সাংবাদিকটি মদ্যপ, গাঁজাখোর, তারপরও কি মধ্যরাতে মোবাইল কোর্ট নিয়ে তার বাড়িতে হামলা করা যায়? সে কি ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধী? নাশকতার পরিকল্পনাকারী? তাকে পাঁকড়াও করতে ৪০ জনের দল লাগে? এ ঘটনায় বিস্মিত হয়ে উচ্চ আদালতও প্রশ্ন করেছেন, আদালত বলেন, ‘একজন সাংবাদিককে ধরতে মধ্যরাতে তার বাসায় ৪০ জনের বিশাল বাহিনী গেল, এ তো বিশাল ব্যাপার! তিনি কি দেশের সেরা সন্ত্রাসী?’ আর ওই সাংবাদিকের ‘স্বীকারোক্তি অনুযায়ী’ যদি তাকে তাৎক্ষণিক দণ্ড প্রদান করা হয়েই থাকে, তাহলে কেন এমন অমানুষিকভাবে পেটানো হবে?

এসব প্রশ্নের জবাব নেই। এসব প্রশ্নের উত্তরে একটি কথাই বলা যায়: তা হলো ক্ষমতার অপপ্রয়োগ। ‘দেখে নেয়া’র মানসিকতা। অপ্রতিহত জবাবদিহিহীন ক্ষমতা মানুষকে বেপরোয়া করে তোলে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ সরকারি আমলাদেরও তাই করেছে। কুড়িগ্রামের ডিসিসহ সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন এর একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মাত্র।

কুড়িগ্রামে দেশের জনপ্রিয় অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানের ওপর প্রতিশোধ নিতেই যে আইন বহির্ভূতভাবে মধ্যরাতে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তাকে শাস্তি দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল–এটা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। তা না হলে মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানোর মতো কোনো জরুরি পরিস্থিতি সেখানে সৃষ্টি হয়নি। যা করা হয়েছে, তা বেআইনিভাবেই করা হয়েছে, ওই সাংবাদিককে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্যই করা হয়েছে। অথচ কাগজে-কলমে ডিসিসহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা হচ্ছেন জনগণের ‘খেদমতকারী’, ‘সেবাপ্রদানকারী’। সেবা প্রদানের নমুনা কি এভাবে একজন নাগরিকের উপর চড়াও হওয়া? কুড়িগ্রামের ডিসিসহ তার বশংবদ কর্মচারীরা যা করেছেন, তাতে কেবল প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করা হয়নি, এর মাধ্যমে একজন সাধারণ নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা হয়েছে। একজন সাংবাদিককে যখন বেআইনিভাবে রাত দুটোয়, পরিবারে অন্য কোনো পুরুষ মানুষের অনুপস্থিতিতে, প্রতিবেশীকে সাক্ষী না করে জেলা প্রশাসকের অফিসে তুলে আনা হয় তখন এর মধ্য দিয়ে প্রশাসন তাদের ক্ষমতাকেই কেবল জাহির করেছে! এটি জনগণের প্রতি হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ। ওই ডিসি এবং রাতের অভিযানে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য কর্মকর্তাদের কেবল প্রত্যাহার নয়, মামুলি বিভাগীয় ব্যবস্থায় নয়, যথাযথভাবে তদন্ত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে অ্যাডমিন ক্যাডারের সদস্যরা একজোট হয়ে হুমকি-ধমকি দিতে পারেন। কিন্তু ন্যায়ের স্বার্থে তাদেরকেও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে রেখে কেবল শ্রেণিস্বার্থের পূজারী হলে আখেরে ভালো কিছু হবে না।

এমনিতেই আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা ভোগ করেন, অনেকে ক্ষমতার দাপটও দেখান। তারা সব সময় চান আলাদা গুরুত্ব, আলাদা মর্যাদা, বাড়তি সুযোগসুবিধা। এই বাড়তি মর্যাদা ও সুযোগসুবিধা ভোগ করতে গিয়ে তাদের অনেকেই সাধারণ মানুষকে বিড়ম্বনায় ফেলেন। অথচ তাদের সেটা করার কথা নয়। জনসেবা, জনকল্যাণ, জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করাই যাদের একমাত্র কাজ হওয়ার কথা। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বা রাষ্ট্রের এসব স্থায়ী কর্মচারীদের ইংরেজিতে বলা হয় পাবলিক সার্ভেন্ট বা জনগণের চাকর। তাদের একমাত্র কাজ জনগণের সেবা করা। কারণ তাদের বেতন-ভাতা হয় সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায়।

আমরা অভিধানে বর্ণিত কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞার আলোকে উপস্থাপিত ‘আদর্শ আমলা’র সন্ধান বড় বেশি পাই না। আমরা সাধারণ অভিজ্ঞতায় দেখি আমলা হচ্ছে সরকারি চাকরি করা বড় বড় পদবিধারী ক্ষমতাধর মানুষ। যাদের কাছে সাধারণ মানুষ সহজে যেতে পারে না। তাদের ‘স্যার’, ‘মহোদয়’ ইত্যাদি সম্মানসূচক বিশেষণ যোগ করে অত্যন্ত আদবের সঙ্গে সম্বোধন করতে হয়। তারা সব সময় একটা অদৃশ্য প্রাচীর রচনা করে চলেন। যেখানে সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে আমলারা সবসময়ই একটা নেতিবাচক ভাবমূর্তির চরিত্র। যাদের মানুষ সমীহ করে, কিন্তু বড় বেশি ভালোবাসে না! বরং অনেক ক্ষেত্রে ঘৃণা করে!

আমাদের দেশে কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতার মতো এই আমলাদের অনেকের মধ্যেও ‘গণশত্রু’ হয়ে ওঠার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে! এটা রাষ্ট্র, সমাজ, সরকার কারও জন্যই শুভ নয়। আমলাদের জন্যও নয়। আমলাদের নিজের দিকে তাকানোর সময় এসেছে। নিজেদের ‘আচরণ’ বদলানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আমলাদের সম্পর্কে দার্শনিক কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ‘নিজেদের নাককেই তাঁরা কর্তব্যের অস্ত্র মনে করেন এবং সব ব্যাপারেই সেইসব অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটান। এই নাক গলানোর কর্মকাণ্ডই তাঁদের কাছে জাতীয় স্বার্থ এবং নিয়মের অর্থ’। তিনি আরও বলেছিলেন, আমলারা সম্পূর্ণভাবে কর্তৃত্বের পূজারি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করে এই আমলাসমাজ। লেনিনও আমলাদের সম্পর্কে একই রকম নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন।

আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগে আমলাতন্ত্র তার নখদন্ত প্রবলভাবে প্রকাশ করতে শুরু করে। আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য দেখে অনেকে একে ‘আমলাশাহী’ও বলে থাকেন। মিশেলসের তত্ত্ব অনুযায়ী দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র তখন গোষ্ঠীতন্ত্রে পরিণত হয় এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কুক্ষিগত করে তোলে। আমাদের দেশে আমলাদের তেমন রূপই আমরা বার বার দেখি। তাই তো অনেকে আক্ষেপ করে বলেন, ‘দেশ তো মন্ত্রীরা চালান না, আমলারা চালান’।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার বঙ্গীয় শব্দকোষে আমলা শব্দের অর্থ বিবেচনা করতে গিয়ে অন্যতম সংজ্ঞা হিসাবে বলছেন: ‘উচ্চ কর্মচারীর অধীন কর্মচারী…’, অর্থাৎ আমলা শব্দের মধ্যেই অধীনতার ঘোষণা আছে। আসলে উপমহাদেশে ‘আমলা’ শব্দটির জন্ম-ইতিহাস রাষ্ট্রকর্মের আধুনিক ইতিবৃত্তে নয়, এর জন্ম ও লালন হয়েছে জমিদারি সেরেস্তায়। অন্তত আমাদের সংস্কারে নায়েব-গোমস্তা-সেরেস্তাভৃত্যদের একটা ছবি ফুটে ওঠে আমলা শব্দটায়। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শব্দকোষ’-এ আমলা শব্দটির নীচেই আছে আরেকটি শব্দ আমলাফয়লা। তার অন্যতম অর্থ মোসাহেব। রবীন্দ্রনাথেও আমলাফয়লাকে দেখা যায় মফঃস্বলি কাছারিতে। ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে কর্তাদের শুভ কাজে ভৃত্যসমাজে উৎসাহের ঢেউ উঠল: ‘আমলা ফয়লা পাইক বরকন্দাজ সবারই গায়ে চড়ল নতুন লাল বনাতের চাদর, রঙিন ধুতি।’ শরৎচন্দ্র আরও স্পষ্ট। ‘দত্তা’য় বিজয়ার ‘দাস-দাসী-আমলা-কর্মচারী’দের উপর নরেন তার স্বত্বের কথা বলে, অন্য দিকে ক্ষুব্ধ বিলাসেরও নায়িকার কাছে ক্ষুণ্ণ প্রশ্ন: ‘আমি চাকর? আমি তোমার আমলা?’ বাংলা সাহিত্যে আমলা মানেই কর্তার বশংবদ ভৃত্য মাত্র। তবে তত্ত্বীয় এসব সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য ছাড়িয়ে আমাদের দেশে বেশিরভাগ আমলা এখন ‘নব্য জমিদারের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ। তারা নিজেরাই নিজেদের নামে নানা ধরনের ‘মহত্ত্বের ছায়া’ আরোপ করে থাকেন। আমলাদের কাছ থেকে মানুষ ‘নিরপেক্ষতার নৈতিকতা’ আশা করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ঘটে না। তারা শাসক দলের ‘চামচা’ অথবা নিজেরাই ক্ষমতাবান ‘অত্যাচারী’ হিসেবে আবির্ভূত হন।

আমাদের দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে অতীতের ধারাবাহিকতায় জনগণের উপর না হয়ে সামরিক, বেসামরিক, আমলাতন্ত্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। আমাদের দেশে এখন সরকারের টিকে থাকার পেছনে জনগণ নয় আমলাদের ভূমিকাই প্রধান। তাই সর্বত্র আমলাতন্ত্রের জয়-জয়কার। এই আমলাদের পরামর্শে ও সাহায্যে সরকার সব গণবিরোধী কুকর্মগুলো করে বলে আমলাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। ফলে তারা একই সঙ্গে গাছেরটা খায় এবং তলারটা কুড়ায়। এদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে সরকারের নৈতিক সাহস থাকে না। কখনো কখনো আমলারা তাদের দুর্নীতির আয়ের ভাগ মন্ত্রী বা আরো উচ্চ পদের কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করে আর্থিকভাবেও লাভবান হয়।

আজীবন চাকরির নিশ্চয়তা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনভিজ্ঞ অপেশাদার মন্ত্রী, দুর্নীতির কারণে চাকুরিচ্যুত করার বদলে বড়জোর বদলি, ওএসডিকরণ বা দুর্নীতি চাপা দেয়ার প্রবণতা, জবাবদিহি না থাকা, সরকারি চাকুরেদের সরকারি দলের অনৈতিক লেজুড়বৃত্তি বা আজ্ঞাবাহী হওয়া, সচিবালয়-মন্ত্রণালয়কে জনসাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখা, সরকারি কর্মচারীদের কর্মস্থলে দলীয় কর্মসূচি পালনে বাধ্য করা এবং পরিবর্তে সরকারি দল কর্তৃক অনৈতিক সুবিধা প্রদান–এসব কারণেই আজ সরকারি কর্মচারীরা পাবলিক সার্ভেন্ট না হয়ে পাবলিকের মাস্টার হয়ে বসেছে।

এটা দুঃখজনক। সরকারকে আমলাতন্ত্র বা আমলাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমলাদেরও নিজেদের ভূমিকা নিয়ে পর্যালোচনার সুযোগ আছে। ক্ষমতার অপব্যবহার, সমাজে নিজেদের ‘ব্রাহ্মণ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা, যুক্তির জোরের পরিবর্তে ‘জোরের যুক্তি’ প্রতিষ্ঠা করা–এগুলো আখেরে কোনো ভালো ফল বয়ে আনে না। এতে জনরোষ সৃষ্টি হতে পারে। এটা রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও ভালো নয়। এমনকি আমলাদের নিজস্ব স্বাস্থ্যের জন্যও তা ভালো নয়। কাজেই কোথাও যেন কোনোরকম বাড়াবাড়ি না হয়, তারা নিজেরা নিজেদের স্বর্গের দেবতা মনে করে ফুল-চন্দনচর্চিত আসনে অধিষ্ঠিত না করেন, সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়া জরুরি।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com