জটিল যক্ষ্মার নতুন ওষুধ
জটিল যক্ষ্মা চিকিৎসায় নতুন ওষুধ মানুষের হাতে আসছে। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যাড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এই নতুন ওষুধের অনুমোদন দিয়েছে। এ বছরের ডিসেম্বর নাগাদ ওষুধটি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আসবে। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কর্মকর্তারা বলেছেন, বাংলাদেশে ওষুধটি ব্যবহারের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে।
ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা (এক্সটেনসিভ ড্রাগ-রেসিসট্যান্ট টিউবারকিউলিসিস বা এক্সডিআর টিবি) চিকিৎসায় এই ওষুধ ব্যাপকভাবে কাজে লাগবে। এই জটিল যক্ষ্মার রোগী সুস্থ করতে এখন ২৪ মাস সময় লাগে। নতুন ওষুধে সময় লাগবে ৬ মাস। যেসব যক্ষ্মা রোগী প্রচলিত ওষুধে ভালো হয় না (অর্থাৎ মাল্টি ড্রাগ রেসিসট্যান্ট বা এমডিআর টিবি), তাদের চিকিৎসায়ও এই ওষুধ ব্যবহার করা যাবে।
প্রেটোমানিড নামের এই নতুন ওষুধ তৈরি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের আরটিআই ইন্টারন্যাশনালের বিজ্ঞানী ডোরিস রৌজ ও তাঁর সহযোগীরা। আন্তর্জাতিক যক্ষ্মাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান টিবি অ্যালায়েন্সের সহযোগিতায় ডোরিস রৌজ ২০০০ সাল থেকে এই ওষুধ তৈরির কাজ শুরু করেন। এ বছরের ১৪ আগস্ট নতুন এই ওষুধের অনুমোদন দিয়েছে এফডিএ। প্রতিষ্ঠিত ধারণা এই যে এফডিএ কড়া নিয়মনীতি মেনে ওষুধ অনুমোদন দেয়।
নতুন এই ওষুধ বিশ্ববাসীকে আশার আলো দেখিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন যক্ষ্মাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্য এবং ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আসিফ মোস্তফা। তিনি বলেন, এখন এক্সডিআর যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসা চলে ২৪ মাস। প্রথম ৬ থেকে ১২ মাস প্রতিদিন একটি করে ইনজেকশন দিতে হয়। এটা একজন রোগীর পক্ষে অসহ্য যন্ত্রণার বিষয়। এখন নতুন ওষুধে সাধারণ যক্ষ্মা রোগীর মতো জটিল যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীদেরও চিকিৎসা চলবে ছয় মাস। মুখে খাওয়ার ওষুধেই তাদের চিকিৎসা চলবে।
এক্সডিআর যক্ষ্মা অত্যন্ত জটিল রোগ। সাধারণ যক্ষ্মার রোগীকে ছয় মাস নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়। নির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়মিত ওষুধ না খেলে বা পূর্ণ মেয়াদে ওষুধ না খেলে যক্ষ্মার জীবাণু ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে ওঠে। সেটাই ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বা এমডিআরটিবি। এই রোগে আক্রান্তরা সরাসরি এমডিআর যক্ষ্মার জীবাণু ছড়ায়। আবার এমডিআর যক্ষ্মার রোগী যদি নির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়ম মেনে ৯ থেকে ১৮ মাস ওষুধ সেবন না করে, তা হলে ওই জীবাণু আরও বেশি মাত্রায় ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। এটাই এক্সডিআর যক্ষ্মা। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কোনো এক্সডিআর যক্ষ্মা রোগী চিকিৎসায় সুস্থ হয়নি।
গত প্রায় ৫০ বছরে যক্ষ্মা চিকিৎসার মাত্র তিনটি নতুন ওষুধের অনুমোদন দিয়েছে এফডিএ। অন্য দুটি ওষুধ হচ্ছে বেডাকুলাইন ও ডেলামিনিড। পাঁচ বছর আগে ওষুধ দুটি বাজারে আসে। নতুন এই ওষুধ বেডাকুলাইন ও লাইনজোলিড ওষুধের সঙ্গে একই সময়ে সেবন করতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বে প্রতিবছর যক্ষ্মায় ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। অর্থাৎ দিনে সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে এই সংক্রামক রোগে। বিশ্বে বর্তমানে আর কোনো সংক্রামক রোগে এত মানুষ মারা যায় না।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে সাড়ে তিন লাখের বেশি যক্ষ্মা রোগী আছে। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগীর অনুমিত সংখ্যা ৫ হাজার ৮০০। এক্সডিআর রোগী আছেন ৬ জন। আর ১২ জন আছেন যাঁরা এমডিআর যক্ষ্মার ওষুধেও ভালো হচ্ছেন না।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক শামিউল ইসলাম বলেন, এফডিএ অনুমোদিত ওষুধটি বিশ্বের অন্যান্য দেশে ব্যবহারের আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের পর বাংলাদেশের যক্ষ্মাবিষয়ক জাতীয় কমিটি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।
১৪টি দেশে ১ হাজার ১৬৮ জন রোগীর ওপর নতুন ওষুধটি কার্যকর ও নিরাপদ কি না, তা দেখা হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার তিনটি স্থানে ১০৯ জন এক্সডিআর রোগীর ওপর তিনটি ওষুধের সমন্বয়ে চিকিৎসার পরীক্ষা হয়েছে।
টিবি অ্যালায়েন্স (দ্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর টিবি ড্রাগ ডেভেলপমেন্ট) একটি অলাভজনক বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান। যক্ষ্মা প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও যক্ষ্মার ওষুধ উদ্ভাবনে তারা কাজ করে। অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডসের সরকারের পাশাপাশি গেটস ফাউন্ডেশনের মতো সংস্থা টিবি অ্যালায়েন্সকে সহায়তা করে।
নতুন এই ওষুধের অনুমোদনের ব্যাপারে টিবি অ্যালায়েন্স ইতিমধ্যে ইউরোপীয় মেডিসিনস এজেন্সি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে আবেদন জানিয়েছে।
যক্ষ্মা রোগ বিশেষজ্ঞ আসিফ মোস্তফা বলেন, ‘টিবি অ্যালায়েন্স একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। সুতরাং আমরা আশা করতে পারি যে নিম্ন আয়ের দেশগুলো কম মূল্যে এই ওষুধ পাবে।