প্রতিরোধই ডায়াবেটিস থেকে বাঁচার উপায়

0

নীরব ঘাতক স্বভাবের ডায়াবেটিস রোগের অব্যাহত বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে সবাইকে সচেতন করে তুলতে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি ২৮ ফেব্রুয়ারিকে ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস হিসেবে পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ দিনটি বেছে নেয়ার কারণ, ১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিগত শতাব্দীর শেষার্ধে সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে গোটা বিশ্বে সবাই উঠেপড়ে লাগলেও এবং গুটিবসন্ত ও পোলিও নির্মূলে সক্ষম হলেও মানুষের সর্বকর্মক্ষমতা হরণকারী অসংক্রামক ব্যাধি ডায়াবেটিসের বিস্তার রোধে ও নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি সচেতনতার অনিবার্যতা এবং এর জন্য সুপরিকল্পিত সর্বজনীন উদ্যোগ গ্রহণে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণের আবশ্যকতা যথা মনোযোগ ও চেতনার চৌহদ্দিতে আসছে না বলে প্রতীয়মান হয়।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান সমস্যা ও সীমাবদ্ধতাগুলোর প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সব দেশের সরকার ও জনগণের তরফে সংহত ও সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ঐকমত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ ২০০৬ সালে জাতিসংঘকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধকল্পে প্রস্তাব গ্রহণের আহ্বান জানায়।

মূলত বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবে এবং যৌক্তিকতার প্রচারণা-প্রয়াসে ১৪ নভেম্বরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে জাতিসংঘ ২০০৬ সালে ৬১/২২৫ নং প্রস্তাব গ্রহণ করে। সেই থেকে জাতিসংঘের সব সদস্য দেশে বিশ্ব ডায়াবেটিক ফেডারেশনের দু’শর অধিক সদস্য সংগঠন, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংস্থা, কোম্পানি, পেশাজীবী সংগঠন ও ডায়াবেটিক রোগীদের মাঝে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস নানা প্রাসঙ্গিক প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে পালিত হচ্ছে।

এবারের ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবসের প্রতিপাদ্য হল ‘ইনসুলিন যার দরকার ইনসুলিন তার অধিকার’। ডায়াবেটিস প্রধানত দু’রকম- ক. ইনসুলিন নির্ভরশীল এবং খ. ইনসুলিন নিরপেক্ষ। ইনসুলিন নির্ভরশীল রোগীদের ইনসুলিনের অভাবের জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়।

ইনসুলিন নিরপেক্ষ রোগীদের দেহে কিছু পরিমাণ ইনসুলিন থাকে। তবে চাহিদার প্রয়োজনে তা যথেষ্ট নয় বা শরীর ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না। এসব রোগীকে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে শর্করা কমানোর বড়ি সেবন করতে হয়।

বর্তমানে ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবসের প্রচার-প্রচারণায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ডায়াবেটিস থেকে রক্ষার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে যাদের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা আছে আর এ চিকিৎসায় নিবেদিত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী- সবারই শিক্ষার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। এর মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসের বিস্তার থামানো, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং এর প্রভাব প্রতিক্রিয়াকে সীমিতকরণ।

এসব প্রচার-প্রচারণার মূল হল ‘থ্রি-ই’ (Education, Engage and Empower) অর্থাৎ সবাইকে এ রোগ সম্পর্কে সচেতন করতে শিক্ষার প্রসার, অধিক সংখ্যক রোগী-সাধারণ মানুষ-চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীকে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ও সেবায় সম্পৃক্তকরণ এবং ডায়াবেটিস রোগীদের নিজেদের কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কে জানানো।

রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে ও পরিবেশের প্রভাবে হয়। কখনও কখনও অন্যান্য রোগের ফলেও হয়ে থাকে। এ রোগ সব লোকেরই হতে পারে। ডায়াবেটিস একবার হলে আর সারে না। এটা সব সময়ের এবং আজীবনের রোগ। তবে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব হয়।

অতিরিক্ত প্রস্রাব, অত্যধিক পিপাসা, বেশি ক্ষুধা, দুর্বল বোধ করা এবং কেটেছিঁড়ে গেলে ক্ষত তাড়াতাড়ি না শুকানো এ রোগের সাধারণ লক্ষণ। যাদের বংশে রক্ত-সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স ৪০-এর ওপর এবং যারা শরীরচর্চা করেন না- গাড়ি চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন, তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অত্যধিক চিন্তাভাবনা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, আঘাত, সংক্রামক রোগ, অস্ত্রোপচার, অসম খাবার, গর্ভাবস্থা এবং ওজন বেশি বেড়ে যাওয়া এ রোগ বাড়াতে সাহায্য করে। এগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করা যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষামতে নগরায়ণ, ‘ওয়েস্টার্ন ফুড’ আর সার্বিক পরিবেশের ভারসমাম্যহীনতা এ রোগের বিস্তারকে করছে বেগবান। বিশ্ব রোগ নিরাময় কেন্দ্রের মতে, এই শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পৌঁছার আগেই এটি মারাত্মক মহামারীরূপে উদ্ভাসিত হবে।

ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা ও ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়। খাদ্যের গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণমতো খাদ্য নিয়মিতভাবে গ্রহণ, জীবনের সব ক্ষেত্রে নিয়মকানুন বা শৃঙ্খলা মেনে অর্থাৎ কাজকর্মে, আহারে, চলাফেরায়, এমনকি বিশ্রামে ও নিদ্রায় শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার। নিয়ম-শৃঙ্খলাই ডায়াবেটিস রোগীর জীবনকাঠি।

ডায়াবেটিস রোগীকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। রোগ সম্বন্ধে ব্যাপক শিক্ষা ছাড়া ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তবে ডায়াবেটিস বিষয়ে শিক্ষা কেবল রোগীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। একই সঙ্গে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং ডাক্তার ও নার্সদের শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। রোগী যদি চিকিৎসকের সঙ্গে সহযোগিতা করে তার উপদেশ ও নির্দেশ ভালোভাবে মেনে চলেন এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে গ্রহণ করেন তাহলে সুখী, কর্মঠ ও দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারেন।

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান; বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ন্যাশনাল কাউন্সিল সদস্য

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com