ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের বীজ বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল: সালাহউদ্দিন
বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের বীজ বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে চলা সংস্কার কার্যক্রমে আলাপ–আলোচনার চেয়ে খাওয়াদাওয়া বেশি হচ্ছে। কিন্তু বিএনপি বিশ্বাস করে, চূড়ান্তভাবে আমরা একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারব।’
তিনি বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের বীজ বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, ‘আমরা জানতাম ফ্যাসিবাদের পতন হবে। কিন্তু কবে, কখন ও কোন পদ্ধতিতে হবে, সেটা আমাদের জানা ছিল না।’
বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) জাতীয় প্রেস ক্লাবের অডিটোরিয়ামে নাগরিক ঐক্যের ১৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে উভয় পক্ষের এমপিরা স্বাধীনভাবে ভোট দেবেন, এমন প্রস্তাব রেখেছে বিএনপি।
তিনি বলেন, আমরা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার প্রস্তাব এনেছি এবং সব দল ঐকমত্য হয়েছে। এবং আমরা আরেকটি প্রস্তাব করেছি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে উভয় পক্ষ স্বাধীনভাবে ভোট দেবে। সেটা আরেকটা বিপ্লব হবে। আর প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছর করার সিদ্ধান্তে একমত হয়েছি, এটাও বড় ধরনের অর্জন। আমরা যদি প্রতি ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগকে সীমাবদ্ধ করি, আইনিভাবে-সাংবিধানিকভাবে তাহলে কিন্তু নির্বাহী বিভাগ দুর্বল হবে। তখন রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা করা যাবে না। নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইনসভা যার যার সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে যেন কাজ করতে পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করলে প্রকৃতপক্ষে সংস্কার হবে। আমরা এমন সংস্কার চাই।
তিনি বলেন, নির্বাচনের সময়ে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বহাল থাকতে হবে। সেজন্যই আমরা দীর্ঘ ১৭ বছর সংগ্রাম করেছি। স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যদি সত্যিকার স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে— সেখানেই কিন্তু স্বৈরাচারের উৎপত্তিটা বন্ধ হয়ে যায়। শুধু নির্বাহী বিভাগকে দুর্বল করার মধ্য দিয়ে কিন্তু রাষ্ট্রে একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো শক্তিশালীভাবে দাঁড় করানো যাবে না।
তিনি বলেন, নির্বাহী বিভাগকে খর্ব করার মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো দাঁড় করানো যাবে না। নির্বাহী বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের কাজ করতে দিতে হবে। বিচার বিভাগ ও আইনসভাকে তার কাজ কাজ করতে দিতে হবে। আর সেখানে থাকবে একটা কমপ্লিট চেক অব পাওয়ার। এটা সেপারেশন অব পাওয়ার থিওরির যেটা মূল কথা। তাহলে রাষ্ট্রের কোনও অর্গান অন্য অর্গানের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, অতীতে একজন সরকার হয়েছিল বলে আমরা নির্বাহী বিভাগকে বিলুপ্ত করতে পারবো না, দুর্বল করতে পারবো না। আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স এবং একটা হারমোনিয়াস কোঅপারেশন— একটা মধুর সম্পর্ক এবং পাহারাদার সৃষ্টি করা, সেফগার্ড সৃষ্টি করার জন্য সব অর্গানকে সেভাবে শক্তিশালী করা। সব গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে একটা শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো যাতে তারা নিজস্ব এখতিয়ারের মধ্যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। তাহলে এদেশে আর কোনদিন স্বৈরাচারের উৎপত্তি হবে না।
বিএনপির এই সিনিয়র নেতা বলেন, শুধু আর্টিকেল ৯৬-এ সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের ব্যবস্থা আছে। সেই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে একজন বিচারককে শুধু অপসারণ করা যায়। কিন্তু অপসারণ শুধু ইউনিটি মেজারস হতে পারে না। একমাত্র শাস্তি হতে পারে না। যদি এখানে ইন্ডিভিজুয়াল ক্রিমিনাল লায়াবিলিটি থাকে সেটা ফিক্স করার জন্য যথাযথ আইন থাকতে হবে। অধস্তন আদালতের জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য একটা সেক্রেটারিয়েট নির্মাণ যথেষ্ট নয়। সেই সেক্রেটারিয়েটের মধ্য দিয়ে অধস্তন আদালতগুলো তাদের জবাবদিহি এবং বিভিন্ন মিসকন্ডাক্টের জন্য ব্যবস্থা নিতে পারবে এমন বিধান থাকতে হবে।
তিনি বলেন, জুডিসিয়ারিতে ইন্ডিপেন্ডেন্টলি, ট্রান্সপারেন্টলি বিচারক নিয়োগ হবে এবং তারা এক পর্যায়ে আপিলেট ডিভিশনে যাবেন সেখান থেকেই চিফ জাস্টিস হবেন। এভাবে রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটা যে ঘুণে ধরা ব্যবস্থা ছিল সেটার সংস্কার হবে, ওভারনাইট হবে না। আমি শুধু রক্ষাকবচ হিসেবে জুডিসিয়ারির কথা বললাম। কিন্তু রক্ষাকবচ হিসেবে এখানে ফ্রিডম অব প্রেস সবচাইতে বেশি জরুরি। যে দেশে ফ্রিডম অব প্রেস শতভাগ, সেই দেশে গণতন্ত্র শতভাগ— সেটা আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে।
সকল রাজনৈতিক দলের উদ্দেশে সালাহ উদ্দিন বলেন, আপনারা কেউ চাইবেন কল্যাণমূলক রাষ্ট্র, আরেকজন চাইবেন অকল্যাণমূলক রাষ্ট্র— এগুলো যেন না হয়। আমরা ভাষণ অনেক দিয়েছি। এখন আমরা এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়েছি যেই জায়গায় শহীদের রক্ত। পিচ্ছিল রাজপথের উপরে তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল অনেক, প্রত্যাশা ছিল অনেক। সে আকাঙ্ক্ষা এবং প্রত্যাশা যেন আমরা পূর্ণ করতে পারি। এবারের শহীদের আকাঙ্ক্ষা এবং প্রত্যাশা যদি আমরা পূর্ণ করতে ব্যর্থ হই— তাহলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ আর দেখি না।
তিনি বলেন, আপনারা এখানে সংস্কার নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন কিন্তু হতাশা কেউ ব্যক্ত করেন নাই। কারণ আমরা সবাই আশাবাদী মানুষ। আলাপ-আলোচনা চলছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আমরা একটা জায়গায় ঐকমত্যে আসতে পারবো। আমরা ঐকমত্যে আসার জন্য আমাদের দলের পক্ষ থেকে কী কী বিবেচনায় নিয়েছি আপনারা ইতোমধ্যে লক্ষ্য করেছেন। আমরা বলেছি, ১০ বছরের বেশি কোনও ব্যক্তি বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীত্বের আসনে বসতে পারবেন না। এখানেই স্বৈরাচারকে রুখে দেওয়া হলো।
গণতন্ত্র রক্ষা করতে হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, গণমাধ্যমকর্মীরা যাতে মালিকের চাকরি না করে বিবেকের চাকরি করেন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে।