৪০০ কোটি ডলার হাতিয়ে লাপাত্তা, কে এই ক্রিপ্টোকুইন

0

‘ওয়ান কয়েন’ নামের একটি ভুয়া ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার হাতিয়ে নিয়েছেন এক নারী। মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এই নারীকে ‘ক্রিপ্টোকুইন’ আখ্যা দিয়ে মোট ওয়ান্টেড ১০ পলাতক আসামির তালিকায় তার নাম যুক্ত করেছে। কে এই ক্রিপ্টোকুইন তা নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে অনলাইন মাধ্যমে।

২০১৭ সালের অক্টোবরে আচমকা গায়েব হয়ে যান ‘ক্রিপ্টোকুইন’। তারপর থেকে হন্যে হয়ে খুঁজেও তাকে ধরতে পারেনি এফবিআই। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছে মার্কিন এই গোয়েন্দা সংস্থা। বৃহস্পতিবার এফবিআইয়ের মোস্ট ওয়ান্টেড অপরাধীর তালিকায় ঢুকে পড়েছেন তিনি।

এফবিআইয়ের খাতায় ‘ক্রিপ্টোকুইন’ নামে পরিচিত এই নারীর নাম রুজা ইগনাতোভা। এফবিআই জার্মানির নাগরিক রুজার বিরুদ্ধে কোটি কোটি ডলার লুটের অভিযোগ করেছে। তার সম্পর্কে তথ্য দিতে পারলে এক লাখ ডলার পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছে এফবিআই।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের গোয়েন্দাদের নজরেও আছেন রুজা। মে মাসে তাকে মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকাভুক্ত করে ইউরোপোল। একই সঙ্গে গ্রেপ্তারিতে সহায়তার তথ্য দিতে পারলে চার লাখ ডলারেরও বেশি পুরস্কার ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপের এই সংস্থাও। তবে ইউরোপ অথবা আমেরিকার গোয়েন্দাদের কেউই এখনও রুজাকে গ্রেপ্তার করতে পারেননি।

৪২ বছরের রুজার জন্ম বুলগেরিয়ার সোফিয়ায়। তবে ১০ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে জার্মানির স্রামবার্গ শহরে চলে যান তিনি। সেখানেই বেড়ে উঠেছেন এবং পড়াশোনা করেছেন তিনি। গোয়েন্দাদের দাবি, অন্যান্য দুর্ধর্ষ অপরাধীর মতো নন রুজা। বরং তিনি উচ্চশিক্ষিত এবং আইনের মারপ্যাঁচ সম্পর্কেও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।

মার্কিন গোয়েন্দাদের দাবি, ২০০৫ সালে জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট ইন্টারন্যাশনাল ল’ নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন রুজা। যদিও অনেকের দাবি, অক্সফোর্ডের পিএইচডি ডিগ্রি রয়েছে তার। উচ্চশিক্ষা শেষে ম্যাকিনসের মতো বহুজাতিক সংস্থায় চাকরিও করেছেন।

২০১১ সালের নভেম্বরে উরসুলায় একটি সালোঁতে বিনিয়োগও করেছিলেন রুজা। তার অপরাধের কাহিনি প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০১২ সালে। সঙ্গে ছিলেন তার বাবা প্লামেন ইগনাতোভও। সে বছর জার্মানির একটি সংস্থার অধিগ্রহণের মামলায় প্রতারণার অভিযোগে দু’জনকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। ওই মামলায় ১৪ মাসের কারাবাসের সাজা হয়েছিল রুজার।

জেলে থাকাকালীনই অপরাধজগতে পাকাপাকিভাবে প্রবেশ করেন রুজা। ২০১৩ সালে বিগকয়েন নামে একটি ক্রিপ্টোকারেন্সির মার্কেটিং সংক্রান্ত প্রতারণায় জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এফবিআইয়ের দাবি, ২০১৪ সালের অক্টোবরে ওয়ান কয়েন নামে ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবসা শুরু করেন। বিশ্বজুড়ে এই কারবারের জাল ছড়াতে ইউটিউবসহ একাধিক নেটমাধ্যমের সাহায্য নিয়েছিলেন রুজা।

আমেরিকান গোয়েন্দারা বলছেন, ওয়ানকয়েনে বিনিয়োগ করলে প্রচুর মুনাফা হবে বলেও প্রচারণা চালাতে থাকেন রুজা। বিনিয়োগকারীরা যত মানুষকে এই ক্রিপ্টোকারেন্সি সংস্থায় টেনে আনতে পারবেন, তাদের তত লাভ হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।

স্মার্ট, মার্জিত চেহারার উচ্চশিক্ষিত রুজার কথায় বিশ্বাস করে অনেকেই ওয়ান কয়েনে বিপুল বিনিয়োগ করেন। এফবিআইয়ের মতে, ওয়ান কয়েন নামের ক্রিপ্টোকারেন্সির আসলে শেয়ারবাজারে কোনও মূল্যই ছিল না। এমনকি ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্লকচেন নামে যে অন্তর্জাল ভিত্তিক প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ হয় এবং যার মাধ্যমে গেলে বিনিয়োগ সুরক্ষিত থাকে সেই সুরক্ষাও ছিল না ওয়ান কয়েনের।

এফবিআইয়ের দাবি, ওয়ান কয়েন আসলে ক্রিপ্টোকারেন্সির ছদ্মবেশে থাকা একটি প্রতারণার জাল। যার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা লুটেছেন রুজা।

ডেমিয়ান উইলিয়ামস নামে ম্যানহাটনের এক আইনজীবী বলেছেন, মোক্ষম সময়ে এই ভুয়া সংস্থা খুলেছিলেন রুজা। যে সময় ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে মাতামাতি তুঙ্গে তখনই তিনি এই কারবার ফেঁদে বসেন। দুই বছরের মধ্যে বিপুল মুনাফা করেছিল ওয়ান কয়েন। ২০১৪ অর্থবর্ষের চতুর্থ ত্রৈমাসিক থেকে ২০১৬ সালে তৃতীয় ত্রৈমাসিকের মধ্যে ওয়ান কয়েন ৩৭৮ কোটি ডলারের মুনাফা করেছিল বলে দাবি এফবিআইয়ের আইনজীবীদের।

শেয়ারবাজারে মূল্যহীন হলেও মাল্টিলেভেল মার্কেটিং পদ্ধতিতে বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে রুজার ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠেছিল। এফবিআইয়ের দাবি, বিশ্বজুড়ে ৩০ লাখ বিনিয়োগকারীকে শুধুমাত্র মোটা অংকের কমিশনের লোভ দেখিয়ে তার ভুয়া সংস্থায় টেনে এনেছিলেন রুজা।

২০১৯ সালে আর্থিক প্রতারণা মামলায় নাম জড়িয়েছিল রুজার ভাই কনস্ট্যানটিন ইগনাতোভের। সে সময় আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ওই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন রুজার ভাই।

এফবিআইয়ের দাবি, অপরাধের নিরিখে বাবা এবং ভাইকে ছাপিয়ে গেছেন রুজা। ২০১৭ সালে বুলগেরিয়ার সোফিয়া থেকে গ্রিসে যাওয়ার বিমানে উঠেছিলেন তিনি। তার সঙ্গে যে পরিমাণ অর্থ ছিল বাংলাদেশি টাকায় তার মূল্য পাঁচ কোটির বেশি। তার পর থেকে সেই যে গা-ঢাকা দিয়েছেন, আজ পর্যন্ত তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।

বিশ্বজুড়ে রুজার নাম ছড়িয়ে পড়ে ২০১৯ সালে। সে বছর বিবিসির তদন্তমূলক পডকাস্টে জায়গা করে নেন তিনি। ‘মিসিং ক্রিপ্টোকুইন’ নামে ওই পডকাস্টটির সাংবাদিক জেমি বার্টলেট দীর্ঘদিন ধরে রুজার বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছেন।

জেমির দাবি, প্রচুর ভুয়া পরিচয়পত্র নিয়ে পালিয়েছেন রুজা। আমাদের বিশ্বাস, এতদিনে হয়তো নিজের চেহারাও পাল্টে ফেলেছেন। জেমি বলেছেন, সম্ভবত আর বেঁচে নেই রুজা! আনন্দবাজার, সিএনএন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com