দোয়া কবুলের ১৫ আদব ও নিয়ম
দোয়া করার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের দোয়া কবুল হয়। আবার অনেকের দোয়া দেরিতে কবুল হয়। এমন অনেকেই আছে যাদের দোয়া কবুল হয় না। কিন্তু কেন কারো দোয়া দ্রুত কবুল হয় আবার কারো দোয়া কবুল হয় না? দোয়া কবুলের জন্য বিশেষ কোনো নিয়ম বা আদব আছে কি? থাকলে সেগুলো কী?
হ্যাঁ, দোয়া কবুলের জন্য বেশ কিছু আদব রয়েছে। কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা সম্বলিত আদবগুলো তুলে ধরা হলো। সেগুলো হচ্ছে-
১. দোয়া শুরুতে মাঝে ও শেষে আল্লাহর প্রশংসা করা
যেমন- আল্লাহু আকবার, আলহামদুলিল্লাহ, সুবহানাল্লাহ বলা।
২. নবিজীর ওপর দরূদ ও সালাম পড়া
নবিজী সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বান্দা যতক্ষণ কোনো গুনাহ অথবা আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছেদের দোয়া না করে এবং তড়িঘড়ি না করে, ততক্ষণ তার দোয়া কবুল হতে থাকে। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ‘তড়িঘড়ি দোয়া করার অর্থ কী?
তিনি বললেন, এর অর্থ হলো- এরূপ ধারণা করা যে,আমি এত দীর্ঘক্ষণ থেকে দোয়া করছি, অথচ এখন পর্যন্ত কবুল হলো না। এরপর নিরাশ হয়ে দোয়া ত্যাগ করা।’ (মুসলিম, তিরমিজি)
৩. দোয়া কবুলের সময় দোয়া করা
দোয়া কবুলের সময় হলো- রাতের শেষ তৃতীয়াংশে, সেজদায়, আজান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়, নামাজের পর, জুমার দিন আসরের পরবর্তী সময়, আরাফাতের দিন এবং ইফতারের সময় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদার ব্যাপারে বলেছেন, ওই সময় বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে বেশি কাছাকাছি হয়। তাই বান্দার দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে।’ (মুসলিম)
৪. সুনির্দিষ্ট বিষয়ে দোয়া করা
দোয়াকে অনির্দিষ্ট করা উচিত নয়। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা এরূপ বলো না যে, আল্লাহ যদি তুমি চাও; আমাকে মাফ করো। বরং চাওয়াকে সুনির্দিষ্ট করতে হবে। কেননা আল্লাহকে বাধ্য করার কেউ নেই।’ (মুসলিম)
৫. কেবলামুখী হয়ে দোয়া করা
কোন সময় দাঁড়িয়ে সামষ্টিকভাবে কেবলামুখী হয়ে দোয়া করার কথাও বর্ণিত আছে। বিশেষ করে জুমার দিন আজানের সময় বা আজান পরবর্তী সময়ে নামাজের আগে দাঁড়িয়ে কেবলামুখী হয়ে দোয়া করার ব্যাপারে তাগিদ রয়েছে।
৬. দোয়া কবুলের জন্য পবিত্রতা অর্জন করা
অজুর সঙ্গে দোয়া করলে আল্লাহ তাআলা বান্দার সেই দোয়া কবুল করেন।
৭. দোয়ার মধ্যে ইসমে আজম পড়া
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আমি একদিন নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে মসজিদে বসা ছিলাম। তখন একজন লোক নামাজ পড়ছিল। সে বললো-
اَللَّهُمَّ اِنِّىْ أَسْأَلُكَ بِاَنَّ لَكَ الْحَمْدُ لَا اِلَهَ اِلَّا اَنْتَ الْحَنَّانُ الْمَنَّانُ بَدِيْعُ السَّمَوَاتِ وَ الْاَرْضِ يَاذَا الْجَلَالِ وَ الْاِكْرَامِ يَا حَىُّ يَا قَيُّوْمُ اَسْأَلُكَ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা বিআন্না লাকাল হামদু লা ইলাহা ইল্লা আংতাল হান্নানুল মান্নানু বাদিউস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি ইয়াজাল ঝালালি ওয়াল ইকরামি ইয়া হাইয়্যু ইয়া কাইয়্যুমু আসআলুকা।
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করি। সব প্রশংসা তোমার জন্য। তুমি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। তুমি স্নেহ ও দয়া দানকারী। আসমান ও জমিনের স্রষ্ঠা তুমি। হে সম্মান ও শ্রদ্ধার মালিক! হে চিরঞ্জীব ও চির অবস্থানকারী তোমার কাছে আশ্রয় চাই।’
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সে ইসমে আজম পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছে। ইসমে আজমের সঙ্গে দোয়া করলে তিনি তা কবুল করেন এবং প্রার্থনা করলে তিনি দান করেন।’ (তিরমিজি, নাসাঈ, আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)
ইসমে আজমের সঙ্গে দোয়া করলে আল্লাহ তাআলা সেই দোয়া কবুল করেন মর্মে হাদিসের একাধিক বর্ণনা থেকে প্রমাণিত।
৮. বিনয়ের সঙ্গে দোয়া করা
দোয়া কবুলের জন্য বিনীতভাবে বারবার আল্লাহর কাছে অনুনয়-বিনয় করা। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘দোয়ায় বারবার অনুনয়-বিনয়কারীকে আল্লাহ তাআলা ভালোবাসেন।’
কেননা এর মাধ্যমে বান্দা নিজের অক্ষমতা, অভাব, ভয়-ভীতি ও চাওয়া-পাওয়ার মনোভাব ব্যক্ত করে, যা আল্লাহ পছন্দ করেন।
৯. দোয়ার সময় উভয় হাত উপরে তোলা
দোয়ার করার সময় উভয় উপরে তোলা উত্তম। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত সাহাল বিন সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ আঙুল কাঁধ বরাবর তুলে দোয়া করতেন।’ (বায়হাকি)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়ার সময় উভয় হাত উপরে তুলে তারপর হাত মুখে মুছতেন।’ (বায়হাকি)
১০. নিচু আওয়াজে দোয়া করা
হজরত আবু মুসা আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, একবার আমরা নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সফর থেকে মদিনায় ফিরে এলাম। তিনি মদিনার কাছাকাছি হয়ে তাকবির বললেন। লোকেরাও উচ্চ আওয়াজে তাকবির বললো। তখন নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে লোকেরা! তোমরা যাকে ডাকছ তিনি বধির ও অনুপস্থিত নন। বরং তিনি তোমাদের ও তোমাদের সাওয়ারির ঘাড়ের মাঝখানে আছেন।’
১১. ছন্দে ছন্দে দোয়া না করা
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘দোয়ায় ছন্দের মিল থেকে দূরে থাকো। তোমাদের জন্য এতটুকু বলাই যথেষ্ট। দোয়ায় কাকুতি-মিনতি ও বিনয়ের ভাব থাকা দরকার। ছন্দ বা কবিতার সেই বিনয়ের পথে বাধা সৃষ্টিকারী।’
১২. আশা ও ভয়ের সঙ্গে দোয়া করা
দোয়া কবুলের জন্য আশা রাখা। আগ্রহরে সঙ্গে দোয়া করা। দোয়া কবুলের জন্য আল্লাহকে ভয় করা। আশা-আগ্রহ ও ভয়ের সঙ্গে দোয়া করলে আল্লাহ তাআলা দোয়া কবুল করেন।
১৩. দোয়ায় উত্তম শব্দ তিনবার উচ্চারণ করা
দোয়া কবুলের জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন করার সময় উত্তম শব্দগুলো তিনবার উচ্চারণ করা। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়া করলে (উত্তম শব্দগুলো) তিনবার বলতেন এবং কোনো কিছু চাইলে তিনবার চাইতেন।’
১৪. জিকির দ্বারা দোয়া শুরু করা
আল্লাহর জিকির বা স্মরণ দ্বারা দোয়া শুরু করা। শুরুতেই কোনো কিছু না চাওয়া। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত সালমা বিন আকওয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাকে কখনও এই কালেমা না বলে দোয়া শুরু করতে শুনিনি।
যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে কোনো প্রার্থনা করতে চায়, তার উচিত, প্রথমে দরূদ পড়া এবং দরূদ দ্বারা দোয়া শেষ করা। কেননা আল্লাহ তাআলা উভয় দরূদ কবুল করেন।
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তোমরা আল্লাহ তাআলার কাছে চাও তখন আমার প্রতি দরূদ পড়। আল্লাহর শান এরূপ নয় যে, কেউ তাঁর কাছে দুইটি জিনিস চাইলে একটি পূর্ণ করবেন এবং অপরটি পূর্ণ করবেন না।ক’
১৫. তাওবা করা
দোয়া করার আগে আল্লাহর কাছে তাওবা করা। অন্যায় থেকে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত আওযায়ী বলেন, লোকজন বৃষ্টির জন্য দোয়া করতে বের হলো। তাদের মধ্যে বেলাল বিন সাদ দাঁড়িয়ে আল্লাহর হামদ পড়ার পর বললেন, উপস্থিত লোকেরা তোমরা নিজের পাপের কথা স্বীকার কর কিনা? সকলেই বললো,নিশ্চয়ই স্বীকার করি। তারপর বললো, হে আমার প্রভু! আমরা শুনেছি, তোমার কোরআন বলছে-
‘নেক লোকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।’
আমরা আমাদের পাপ স্বীকার করেছি। তোমার ক্ষমা আমাদের মতো লোকদের জন্যই। আমাদের ক্ষমা করো; রহম করো এবং আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করো। তারপর হজরত বেলাল বিন সাদ হাত তুললেন, লোকেরাও হাত তুললো। দেখতে দেখতে বৃষ্টি বর্ষিত হলো।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, দোয়া কবুলের জন্য ‘দোয়ার আদব’ রক্ষা করা। উল্লেখিত বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া। কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা মেনে চলা। তবেই মহান আল্লাহ তাআলা বান্দার সব চাওয়া-পাওয়া পূর্ণ করবেন।
আল্লাহ তআলা মুসলিম উম্মাহকে দোয়ার আদব রক্ষা করার তাওফিক দান করুন। দোয়া কবুলে দোয়ার আদবের প্রতি লক্ষ্য রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।