দেশপ্রেমের চশমা: দেশের আমলাতন্ত্র কতটা জনবান্ধব?

0

বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের মানের অবনমন ঘটেছে। সব কাজের ক্ষেত্রে আমলাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। আমলা হলেই যে মন্দ হবেন এমন ধারণা ঠিক নয়। অনেক জ্ঞানী-গুণী আমলা আছেন, যারা তাদের নিজ এলাকায় প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন। তবে সততার সঙ্গে জনগণকে সেবাদানকারী আমলার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।

এর নানা কারণ রয়েছে। সর্বপ্রথমে বলা যায়, আমলাতন্ত্রের মেধাভিত্তিক নিয়োগ সব সময় নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে গলদ রয়েছে। এমসিকিউ পদ্ধতির মাধ্যমে যে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়া হয়, তার মধ্য দিয়ে মেধা যাচাই হয় না। আবার লিখিত পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষায় ২০০ নম্বরের বিধান করার পর থেকে স্বজনপ্রীতি করার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।

সবকিছু মিলিয়ে যারা বিসিএস পরীক্ষায় বিভিন্ন স্তর পাশ করে সরকারের বিভিন্ন ক্যাডারে যোগ দিচ্ছেন, তারা সবাই প্রত্যাশিত মাত্রায় যোগ্যতা নিয়ে আসতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না।

এর অর্থ এই নয় যে, বর্তমানে আমলাতন্ত্রে যারা কাজ করছেন তারা সবাই অযোগ্য। এদের মধ্যেও অনেক যোগ্য লোক রয়েছেন; কিন্তু আমলাতন্ত্রের ওপর রাজনীতির প্রভাব পড়ায় যোগ্যরা স্তাবক আমলাদের চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের অপরিপক্বতার কারণে ক্রমান্বয়ে দেশ পরিচালনায় আমলারা অধিকতর প্রভাব বিস্তার করছেন। অনেক অবসরপ্রাপ্ত আমলা আবার সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে লাইমলাইটে আসার চেষ্টা করছেন। এর অন্যতম কারণ হলো রাজনৈতিক দলগুলো যোগ্য রাজনৈতিক নেতা তৈরি করতে পারছে না। রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় এ ক্ষেত্রে সৎ, যোগ্য ও পেশাদার রাজনৈতিক নেতা তৈরি হচ্ছে না। সরকারি নেতৃত্ব দুর্বল হওয়ায় সব সরকারি কাজে সরকার আমলাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এমনকি সরকার স্বাধীনতা পদক প্রদানেও সাহিত্যবোদ্ধাদের পরিবর্তে আমলাদের দিয়ে তালিকা প্রণয়ন করছে।

এজন্য সর্বপ্রথমে আমলাদের যোগ্যতা সুনিশ্চিত করার জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় হাত দিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে সুযোগ্য শিক্ষার্থীরা আমলাতন্ত্রে প্রবেশ করতে পারবেন। তারপর শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাদের নিয়োগ পদ্ধতিতে। বর্তমানের বিসিএসে ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার নম্বর অনেক কমিয়ে দিতে হবে। মুখস্থ বিদ্যানির্ভর এমসিকিউ পদ্ধতির প্রচলন বন্ধ করতে হবে।

রাজনৈতিক পরিচয়ের ডিএনএ টেস্ট করে কোনো মেধাবী শিক্ষার্থীকে চাকরি পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন মতাবলম্বী বা পূর্ববর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন আমলাদের ওএসডি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বিভিন্ন ক্যাডারে সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগের কাজ করা পিএসসিকে ঢেলে সাজিয়ে সেখানে মেধাবীদের নিয়োগ দিতে হবে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও সরকারঘনিষ্ঠদের আত্মীয়স্বজনদের পিএসসির সদস্য না করে এ ক্ষেত্রে মেধাবীদের নিয়োগ দিতে হবে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে স্বাধীনভাবে পেশাদারত্বের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা বাছাইয়ের কাজ করতে দিতে হবে।

নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরি-পূর্ব প্রশিক্ষণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। প্রশিক্ষণ শেষে চাকরিতে প্রবেশ করলে নতুন চাকরিপ্রাপ্তদের প্রবেশন পিরিয়ড দীর্ঘ করতে হবে। এ সময় তাদের যোগ্যতা ও সততা গোপনভাবে পরীক্ষা করা যেতে পারে। এ কাজে প্রয়োজনে স্টিং অপারেশনের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। প্রশাসন জনগণকে সেবা প্রদানের কাজে গুরুত্ব কমিয়ে নিজের উন্নয়নে যাতে কাজ না করতে পারেন, তার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে।

কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক ও শ্রেণিকক্ষের লেকচারের মধ্যে প্রশিক্ষণ কাজ সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। ফিল্ড ওয়ার্কের ব্যবস্থা বাড়িয়ে কর্মকর্তাদের বাস্তব জ্ঞানার্জনের সুযোগ দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ যতদূর জানি, পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে এখনো মধ্যযুগীয় ভঙ্গিমায় ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এসব বাদ দিয়ে তাদের উন্নত যানবাহন, হেলিকপ্টার চালানো প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

প্রশিক্ষণ যেন যুগোপযোগী হয় সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। ব্রিটিশ আমলের ১৮৭৩ সালের পুলিশ আইনে পুলিশ চললে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ হবে না। অতি দ্রুত পুলিশ আইন সংস্কার ও যুগোপযোগী করে পুলিশকে সে আইনের আওতায় আনতে হবে।

প্রশাসন তো জনগণের জন্য। প্রশাসকরা তো নাগরিক সমাজের সেবক। অথচ প্রশাসনে ব্যাপকভাবে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ায় জনগণ প্রশাসনে যেতে ভয় পান। যারা যান তারা পদে পদে হয়রানির শিকার হন। দুর্নীতিবাজ প্রশাসকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে প্রশাসনের সব স্তরে সেবামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কী নির্বাচনের সময়, বা কী স্বাভাবিক সময়, প্রশাসকদের কিছুতেই অঘোষিত রাজনৈতিক ডিকটেশনে কাজ করা উচিত হবে না। তাদের যাতে দলীয়করণ করা না হয়, সে ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে।

প্রশাসকের কাছে সব সরকার সমান। যে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতাসীন হবে, প্রশাসনযন্ত্রকে সে সরকারের গৃহীত পলিসি বাস্তবায়নে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তবে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে প্রশাসনে পেশাদারত্ব সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না। পরিবর্তে এমন নেতৃত্ব ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে এবং ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্যে প্রশাসনকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করবে। আর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বের এমন মেলবন্ধন রচিত হলে জনগণ প্রশাসন থেকে প্রত্যাশিত সেবা পাবেন না। তবে প্রশাসকরাও যথেষ্ট দূরদর্শী। তারা আবহাওয়া বুঝে ভূমিকা বদলান।

আমরা প্রশাসকদের রাজনৈতিক ভূমিকায় দেখতে চাই না। প্রশাসন অরাজনৈতিক, নিরপেক্ষ, জনবান্ধব ও পেশাদার হলে সবার জন্য মঙ্গলজনক। আমরা আশা করব, একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচনে নির্বাচিত এবং সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য সরকার আগামীতে যেন প্রশাসনের মান, যোগ্যতা ও পেশাদারত্ব রক্ষায় সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করে।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com