মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে আন্ডারওয়ার্ল্ড
দীর্ঘদিনের শান্ত ঢাকা ফের অশান্ত হয়ে উঠছে। বিদেশে পলাতক আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আধিপত্য বিস্তারে ফের খুনোখুনি শুরু করেছেন তারা। রাজধানীতে যখন খুনের ঘটনা কমে আসছিল, তখন আন্ডারওয়ার্ল্ডের এমন তৎপরতা নতুন করে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
মতিঝিলের মতো ঢাকার অন্যান্য এলাকায় যাতে তারা কোনো ধরনের অপতৎপরতা চালাতে না পারে সেজন্য আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছেন গোয়েন্দারা। আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশন আছে-এমন সন্ত্রাসীদের বিশেষ নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনমনে স্বস্তি ফেরাতে আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণের কঠোর বার্তা দিতে হবে। পাশাপাশি দেশের বাইরে পলাতক সন্ত্রাসীদের ফেরানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন বলেন, খুন করে পার পাওয়ার দিন চলে গেছে। ঢাকায় যেসব খুনের ঘটনা ঘটছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। আর আন্ডারওয়ার্ল্ডের ধারণা এখন অতীত। যে কেউ চাইলেই সেই পুরোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে পারবে না। এজন্য আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। সম্ভাব্য যেসব এলাকার নাম আসছে সেগুলোতেও বিশেষ নজরদারি রয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, গত ১৩ বছরে নগরীতে তিন হাজার ৩৭৫টি খুনের ঘটনা ঘটে।
২০০৯ সালের পর থেকে ঢাকায় খুনের সংখ্যা আর ৩০০ পার হয়নি। ২০১৬ সালে খুনের সংখ্যা দুইশ’র নিচে নেমে এসেছিল। এর মধ্যে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ছিল। তবে মোট হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগই হয় ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে। কিন্তু ২৪ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর উত্তর শাহজাহানপুর এলাকায় সড়কে প্রকাশ্য গুলিতে নিহত হন আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী ফ্রিডম মানিক ও জিসানের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রগুলো বলছে, মূলত এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মতিঝিল এলাকায় নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পাশাপাশি একটা ‘ম্যাসেজ’ দিতে চেয়েছে সন্ত্রাসীরা। তাদের নামে চাঁদাবাজিসহ ঢাকায় যেসব অবৈধ কর্মকাণ্ড চলে সেগুলোর গতি ত্বরান্বিত করাও ছিল এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম উদ্দেশ্য।
আন্ডারওয়ার্ল্ড ও গোয়েন্দা সূত্র বলছে, মতিঝিলের ঘটনার পর অন্যান্য এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা নিয়েও এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের তৎপরতা রয়েছে এমন এলাকাগুলো নতুন ভয়ের জায়গা তৈরি করেছে। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে ব্যাংককে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী নবী উল্লাহ নবী। এই এলাকার বিভিন্ন খাত থেকে চাঁদা যায় তার কাছে। ধানমন্ডি এলাকায় এখনো প্রভাব বিস্তার করে আছে শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন। কারাগারে বসেই তিনি এই এলাকার অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছেন। একাধিক আলোচিত হত্যাকাণ্ডের পেছনে তার হাত থাকার তথ্য আছে গোয়েন্দাদের কাছে। তবে রামপুরা, গুলশান, বাড্ডাসহ রাজধানীর একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রক জিসান। দুবাইয়ে পলাতক এই শীর্ষ সন্ত্রাসীর কিলার বাহিনীর সদস্যরা এখনো পুরোমাত্রায় সক্রিয়। তার সঙ্গে সমঝোতা করেই ভারতে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক ও মোল্লা মাসুদ সম্প্রতি গণপূর্ত, ক্রীড়া পরিষদ, রাজউক ও রেলওয়ের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এর জের ধরেই সম্প্রতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজধানীর অপরাধ জগত।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে ঢাকায় খুন হন ৩২৪ জন, ২০০৯ সালে ৩২১, ২০১০ সালে ২৪৫, ২০১১ সালে ২৫৯, ২০১২ সালে ২৬৪, ২০১৩ সালে ২৭০, ২০১৪ সালে ২৬২, ২০১৫ সালে ২৩৯, ২০১৬ সালে ১৬৫, ২০১৭ তে ২১৮, ২০১৮ সালে ২১৬, ২০১৯ সালে ২০৭, ২০২০ সালে ২১৯ এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে ১৬৬ জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান এবং তদারকির ফলেই খুন কমছিল বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বলছে, খুনে জড়ালে ‘পার পাওয়া যাবে না’ এমন একটি ‘ম্যাসেজ’ মানুষের মধ্যে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। সেজন্যই খুনের ঘটনা কমে আসছিল। সম্প্রতি মতিঝিলের খুনের ঘটনায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় এ বিষয়ে তারা আরও তৎপর হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে খুনের ঘটনাগুলো মনোজগতে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে তা সরাসরি শঙ্কার জায়গা তৈরি করে না। কিন্তু আন্ডারওয়ার্ল্ড আধিপত্য বিস্তারে যখন খুনোখুনিতে জড়িয়ে যায় তখন তা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য আন্ডারওয়ার্ল্ডভিত্তিক এসব চক্রকে থামানো অত্যন্ত জরুরি।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, আন্ডারওয়ার্ল্ডের ট্রেন্ড থেকে আমরা বহু আগেই বেরিয়ে গেছি। ক্যাসিনোকান্ডের পর সেটি আবার শোনা যায়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা কঠোরভাবে দমন করেছিল। এরপর মতিঝিলের টিপু হত্যাকাণ্ডের পর আবার তা শোনা যাচ্ছে। মূলত এলাকাভিত্তিক দাপট দেখাতেই রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে এই কাজগুলো হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে অর্থনৈতিক সংযোগ। যখন খুনের ঘটনাগুলো কমে আসছে তখন আন্ডারওয়ার্ল্ডের এমন তৎপরতা কোনোভাবেই হতে দেওয়া যাবে না। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের যারা দেশের বাইরে আছে তাদের ফেরানোর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি দেশে যারা তাদের সহায়তা করছে তাদের নজরদারিতে রাখতে হবে। কারাগারে যারা আছে, তারা যাতে বাইরের কোনো কিছুতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।