দেশে একের পর এক সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা জনমনে উদ্বেগ তৈরি করছে। বিশেষ করে বিভিন্ন বয়সী নারী ও মেয়ে শিশুরা এখন তাদের পরিবারের সঙ্গে ঘরের বাইরে বেরিয়েও নিরাপদ নয়। নারী ও মেয়েটি একদিকে শিকার হচ্ছে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অন্যদিকে তার সঙ্গে থাকা আপনজনটিও বিপদমুক্ত নয়। সামান্য কথা কাটাকাটি থেকে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ধর্ষকরা প্রতিশোধ নিতে সংঘবদ্ধভাবে ভুক্তভোগীর ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। আর সঙ্গে থাকা মা-বাবা, ভাইবোন, স্বামী বা বন্ধুর ওপর সহিংস আক্রমণ চালাচ্ছে। চলন্ত বাসেও এ ধরনের ঘটনা বিভিন্ন সময় ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মেয়েদের নির্জন স্থানে আপনজনদের সঙ্গে একাকী চলাফেরা করতে নিরুৎসাহিত করছেন।
নরসিংদীর পলাশে গত ৫ ফেব্রুয়ারি স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক গৃহবধূ। উপজেলার ঘোড়াশাল রেলস্টেশন এলাকায় স্বামীর সঙ্গে রেলপথ ধরে ঘোরাঘুরির সময় তিন বখাটে ওই দম্পতিকে পথরোধ করে তাদের পরিচয় জানতে চায়। পরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের একটি নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে স্বামীকে আটকে মারধর করা হয় এবং স্ত্রীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়।
এর আগে ২০২০ সালে সিলেটের বালুচর এলাকার এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে নিয়ে বেড়াতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন আরেক গৃহবধূ। এই ঘটনায় তখন দেশব্যাপী তুমুল আলোড়ন তৈরি হয়। ওই ভুক্তভোগীর স্বামীকে ধর্ষকরা বেঁধে মারধর করে তাকে ছাত্রাবাসে নিয়ে ধর্ষণ করে। খবর পেয়ে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে। সেদিন রাতেই নির্যাতিতার স্বামী শাহপরান থানায় মামলা করেন।
সম্প্রতি ঢাকার ধামরাইয়ে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে পোশাক কারখানার এক শ্রমিককে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে উত্ত্যক্তকারী সেই যুবকসহ তিনজন। এই ঘটনায় মেয়েটির স্বামী বাদী হয়ে ধামরাই থানায় মামলা করলে গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে উত্ত্যক্তকারী রিফাত হোসেন নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়।
গত বছরের শেষে নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায় চলন্ত বাসে এক তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় বাসের চালক ও চালকের দুই সহকারীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মদনপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে এ ঘটনাটি ঘটে। পরে ভুক্তভোগী তরুণী জাতীয় জরুরি সহায়তা নম্বর ৯৯৯-এ যোগাযোগ করলে পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে।
ভুক্তভোগী জানান, বাসটি চিটাগাং রোডে আসার পর সব যাত্রী নেমে যায়। কিন্তু বাসটি সেই তরুণীকে নিয়ে বন্দরের মদনপুর বাসস্ট্যান্ডের জাহিন গার্মেন্টের সামনে যায়। এ সময় উচ্চৈঃস্বরে গান বাজিয়ে চালকসহ আরও তিনজন তরুণীটির ওপর নির্যাতন চালায়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৬৫টি। এর মধ্যে ৪৫টি ঘটনাতেই ধর্ষণের শিকার শিশু ও কিশোরী। এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১২টি।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)-এর তথ্যে এমনটি জানা যায়। আর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ১০৬৬টি। এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ২৫২টি এবং এতে মৃত্যু হয় নয়জনের।
অভিজ্ঞমহলের মতে স্বামী, বাবা, ভাই বা বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে থাকা অবস্থায় যখন একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয় তখন একা নয় ধর্ষকরা সেই নারীকে দলগতভাবেই নির্যাতন করার চেষ্টা করে। এই অপরাধীরা দলগতভাবে এই অপকর্ম ঘটানোর পরিকল্পনা করে। এই অপরাধটি দলগতভাবে করলে মেয়েটির সঙ্গে থাকা মানুষটিকে আটকে রাখা বা মেয়েটিকে পাশবিক নির্যাতন করা অপরাধীদের কাছে সহজ হয়ে যায়। অর্থাৎ ধর্ষণের শিকার মেয়েটির সঙ্গে এখানে সঙ্গে থাকা মানুষটিও ঝুঁকিতে পড়ে যায়। বখাটেরা বেশিরভাগই এখন দলগতভাবে ঘোরাফেরা করে। এ জন্য সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাগুলোও বেশি ঘটছে। আবার দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যরা দায়িত্বরত অবস্থায় ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, হয় তারা গল্পে মেতে আছে, নয়তো মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মেয়েদের নির্জন স্থানে আপনজনদের সঙ্গে একাকী চলাফেরা করা উচিত নয়। আর কাজের সময় দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ সব নিরাপত্তা কর্মীর মোবাইল ফোন ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে হবে। এক্ষেত্রে কাজের প্রয়োজনে শুধু দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি মোবাইল ব্যবহার করতে পারেন। আবার অনেক হোটেলে যেখানে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে সেখানে অপরাধের সঙ্গে সেই হোটেলের ম্যানেজার ও হোটেল বয়দের এক ধরনের যোগাযোগ থাকে। এই হোটেলগুলোতে দিনরাত নানা ধরনেরর অসামাজিক কার্যকলাপ ঘটে। সেখানে বসেই তারা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মতো অপরাধ ঘটানোর পরিকল্পনা করতে পারে।