সিনহাকে খুন করতে কেন মরিয়া হন ওসি প্রদীপ?

0

সেনাবাহিনীর মেজর পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসরের পর ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলের ধরার জন্যই কাজ করছিলেন সিনহা মো. রাশেদ খান। এ কাজের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করছিলেন তিনি। তবে, কক্সবাজারের টেকনাফ গিয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ এবং তাঁর পেটোয়া বাহিনীর নানা অপকর্ম জেনে ফেলেন সিনহা মো. রাশেদ। এসব তথ্য ফাঁস হলে নিজের পেশাগত জীবনের ক্ষতি হতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকেই সিনহা মো. রাশেদকে হত্যার ছক তৈরি করেন ওসি প্রদীপ।

২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজা‌রের ‌সি‌নিয়র জু‌ডি‌শিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে সিনহা মো. রাশেদ হত্যার কারণ সম্পর্কে এভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। হত্যা মামলাটি তদন্ত করেছেন কক্সবাজার র‍্যাব-১৫-এর দুই কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার মো. জামিলুল হক ও সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম। প্রায় এক বছরের শুনানি, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও যুক্তিতর্ক শেষে আগামীকাল ৩১ জানুয়ারি সোমবার আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈল। মামলার শুনানিতে আসামিদের পক্ষে প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত, আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম।

অভিযোগপত্রের ১২ পাতার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়, সিনহা মো. রাশেদ খান দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার লক্ষ্যে ‘JUST GO’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ চ্যানেলের ডকুমেন্টারি কনটেন্ট তৈরি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি ভিডিওচিত্র ধারণ করেন। এ সময় তাঁরা বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য নিরলস কাজ করছিলেন। এজন্য তিনি গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে ঘুরে ভ্রমণ-পিপাসুদের জন্য বিভিন্ন স্থানের প্রামাণ্যচিত্র ধারণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে ২০২০ সালের ৭ জুলাই কক্সবাজারের রামু থানাধীন হিমছড়ি নীলিমা রিসোর্টের একটি কটেজে উঠেন। সেখানে তিনি আশপাশের চিত্রধারণসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের জীবন-জীবিকার তথ্যাদি সংগ্রহ করেন এবং তা ভিডিওচিত্রে ধারণ শুরু করেন।

এরপর সিনহা মো. রাশেদ টেকনাফেও একই ধরনের প্রামাণ্যচিত্র ধারণ শুরু করেন। তখন লোকমুখে এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবন-জীবিকার তথ্য সংগ্রহ করার সময় ওসি প্রদীপের মাদক নির্মুলের নামে টেকনাফ থানার নিরীহ মানুষের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন নিপীড়নের তথ্য জানতে পারেন। নির্যাতনের শিকার অনেক ভিকটিম পরিবারের সদস্য সিনহা এবং তাঁর সহযোগীদের কাছে প্রদীপের অত্যাচার-নীপিড়নের রোমহর্ষক বর্ণনা দেন। এসব শুনে সিনহা এবং তাঁর সহযোগীরা ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলী এবং তাঁদের পেটুয়া বাহিনীর নাম সংগ্রহের চেষ্টা করেন।

এসব কাজের একপর্যায়ে ওসি প্রদীপের সঙ্গে সিনহা মো. রাশেদ, শিপ্রা দেবনাথ ও সাহেদুল ইসলাম সিফাতের দেখা হয়ে যায়। তখন তাঁদের সঙ্গে ক্যামেরাসহ ভিডিও ধারণের নানা সরঞ্জাম ছিল। তাঁরা ওসি প্রদীপের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন। তখন প্রদীপ তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন এবং তাঁদের এসব কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। ওসি প্রদীপ এও বলেন, তিনি মেজর-টেজর-এর ধার ধারেন না। তিনি বহু সাংবাদিককে পিটিয়েছেন, জেলে পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁদের ভয়ভীতি দেখান, হুমকি দেন এবং কক্সবাজার জেলা ছেড়ে যেতে বলেন। ওসি প্রদীপ তাঁদের হুমকি দিয়ে বলেন, ইন্টারভিউ, ভিডিওচিত্র বানিয়ে ইউটিউবে প্রচার করে তাঁর কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে এবং কর্তৃপক্ষকে জানালে মেজর সাহেব ও তাঁদের ধ্বংস করে দেবেন। এরপর ওসি প্রদীপ তাঁর থানা এলাকায় নিয়োজিত সব সোর্সের সঙ্গে কথা বলেন এবং গোপন বৈঠক করেন।

অভিযোগপত্রের একই পাতার তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়—ওসি প্রদীপের হুমকির বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্ব না দিয়ে সিনহা এবং তাঁর সঙ্গীরা নিলীমা রিসোর্টে অবস্থান করেই প্রামাণ্যচিত্রের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তাঁরা কক্সবাজার না ছাড়ায় ওসি প্রদীপের সন্দেহ হয়—সিনহা মো. রাশেদ সেনাবাহিনীর সাবেক অফিসার পরিচয় দিয়ে টেকনাফে তাঁর থানা এলাকায় তাঁর নানা কুকর্মের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে ক্ষতিগ্রস্ত ভিকটিম পরিবারের লোকজনের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করছে। এসব অপকর্মের বিষয়গুলো প্রচার হলে তাঁর চাকরির বিরাট ক্ষতি হবে অনুধাবন করে বিষয়টি তিনি বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে জানান। অতঃপর তিনি থানা এলাকায় নিয়োজিত সব সোর্সের সঙ্গে কথা বলেন এবং গোপন বৈঠক করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলী তাঁদের সোর্স মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আইয়াজ এবং আসামি মো. নিজাম উদ্দিনের মাধ্যমে সিনহা এবং তাঁর সঙ্গীদের সম্পর্কে খবরা-খবর নেওয়ার চেষ্টা করেন। সিনহা এবং তাঁর সঙ্গীদের দেখা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রদীপ ও থানা পুলিশকে তাৎক্ষণিকভাবে খবর দেওয়ার জন্য সোর্সদের বলেন। শুধু তাই নয়, প্রদীপ কুমার দাশের নির্যাতনে ক্ষতিগ্রস্ত টেকনাফ খানার হাম জালাল (৫০), মো. আলী আকবর (৪৪), ছেনোয়ারা বেগম (২৪), সালেহ আহমদ (৫০), বেবি বেগমদের (৩০) বাড়িতে সাদা পোশাকে পুলিশ পাঠানো হয় এবং সিনহা এবং তাঁর ভিডিও টিমের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হয়।

অভিযোগপত্রের ১৩ পাতার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়—জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে মো. লিয়াকত আলী পুলিশের সোর্সদের সিনহা এবং তাঁর ভিডিওদলকে তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সিনহা মো. রাশেদ।

হত্যাকাণ্ডের চার দিন পর ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে নয় জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক  মো. লিয়াকত আলীকে (৩১)। ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে (৪৮) দুই নম্বর এবং বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিতকে (৩০) তিন নম্বর আসামি করা হয়। বাকি ছয় আসামি হলেন উপপরিদর্শক (এসআই) টুটুল, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. লিটন মিয়া (৩০), কনস্টেবল ছাফানুর করিম (২৫), মো. কামাল হোসাইন আজাদ (২৭), মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন ও মো. মোস্তফা। আদালত মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেন কক্সবাজারের র‍্যাব-১৫ কে। ৭ আগস্ট মামলার সাত আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁরা হলেন—লিয়াকত আলী, প্রদীপ কুমার দাশ, নন্দ দুলাল রক্ষিত, মো. লিটন মিয়া, ছাফানুর করিম, মো. কামাল হোসাইন ও মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন। তবে, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফা আত্মসমর্পণ করেননি।

র‍্যাব তদন্তে নেমে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরও আট জনের সংশ্লিষ্টতা পায়। তাঁরা হলেন—ওসি প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা (৩০), বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব, বরখাস্ত এপিবিএনের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. শাহজাহান আলী (৪৭), বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব হোসেন (২৩) ও আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (২০), স্থানীয় বাসিন্দা  টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন (২২), মো. নিজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ আইয়াজ (৪৫)। তাঁদের মধ্যে সাগর দেব বাদে সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়।

হত্যাকাণ্ডের পর চার মাসেরও বেশি সময় ধরে তদন্তের পর ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর র‍্যাব ১৫-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে এজাহারভুক্ত নয় আসামির মধ্য থেকে এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফাকে বাদ দেওয়া হয়। অভিযুক্ত বাকি পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব ২০২১ সালের ২৪ জুন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এর মাধ্যমে অভিযুক্ত ১৫ আসামি গ্রেপ্তার ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আইনের আওতায় আসেন।

অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ মামলায় মোট ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়। ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৫ জন ব্যক্তি আদালতে সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হওয়ার পর ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থনে আসামিদের বক্তব্য গ্রহণ করা হয়। এরপর চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আদালত আগামীকাল ৩১ জানুয়ারি সোমবার রায়ের জন্য দিন ধার্য করেন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com