নির্যাতিত শত শত পরিবারের রোজা-নামাজ, চাওয়া একটাই ওসি প্রদীপের ফাঁসি
দেশব্যাপী তুমুল আলোচিত সেনাবাহিনীর ( অব.) মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় ওসি প্রদীপসহ ১৫ আসামির কী ধরনের সাজা হয় তা নিয়ে কৌতুহল রয়েছে জনমনে।
বিশেষ করে ভুক্তভোগী ও নিহতদের পরিবার প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। সোমবার (৩১ জানুয়ারি) আলোচিত ওই মামলার রায় দেওয়া হবে।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. ইসমাঈল সেদিন এ মামলার রায় ঘোষণা করবেন।
সিনহা হত্যা মামলার রায় নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক কৌতুহল রয়েছে। রায়ের আলাদা আগ্রহ রয়েছে কক্সবাজার জেলার মানুষের কাছে। বিশেষ করে টেকনাফ থানার ওসি থাকাকালীন প্রদীপের হাতে নির্যাতিত শত শত পরিবারের আগ্রহটা সবচেয়ে বেশি।
আদালতের রায়ে তাদের চাওয়া একটাই যেন টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার সহযোগীদের ফাঁসি হয়। এ জন্য গত কয়েকদিন ধরে রোজা রাখার পাশাপাশি তাহাজ্জতের নামাজ পড়ছেন টেকনাফের শত শত ভুক্তভোগী পরিবার।
সূত্র জানায়, প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ ওসি থাকাকালীন মাদক নির্মূলের নামে ২২ মাসে ১৪৪টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে। তাতে মারা গেছে ২০৪ জন। নিহত সবাইকে দেয়া হয়েছে মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারের তকমা। অথচ সাধারণ মানুষ বলছে, ক্রসফায়ারে নিহতদের বেশিরভাই ছিল নিরীহ মানুষ।
টেকনাফের হীল্লা ইউনিয়নের সন্ত্রাসী তাকমা দিয়ে একই পরিবারের তিন ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে প্রদীপ।
এ পরিবারের সদস্য মো. আলম বলেন, ‘খুনের শিকার’ তিন ভাইয়ের বউ এবং এতিম ছেলেমেয়েরা প্রত্যাশা করছেন ওসি প্রদীপ ও ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন; তাদের যেন ফাঁসি হয়। এ জন্য গত কয়েকদিন ধরে রোজা রাখে আল্লাহ কাছে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে দোয়া করে যাচ্ছেন।
টাকার বিনিময় প্রতিপক্ষের সঙ্গে চুক্তি করে তার তিন ভাইকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে জড়িতের বেশ কয়েকজন সিনহা হত্যা মামলায় আসামি হয়ে কারাগারে রয়েছে বলে জানান তিনি।
টেকনাফের ওসি থাকাকালীন দুই মেয়েকে ধর্ষণ করেছে প্রদীপ দাবি করে এক ভুক্তভোগী নারী বলেন, মেজর সিনহা হত্যার রায়ের দিন নির্ধারিত হওয়ার পর থেকে বিচারক যেন প্রদীপের ফাঁসি দেন এ জন্য তিনি রোজা রাখছেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করে যাচ্ছেন। ধর্ষণের ঘটনায় আদালতে মামলা করলেও এখনো পর্যন্ত মামলার কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাননি বলে জানান তিনি।
টেকনাফ হোয়াইক্যংয়ের স্থানীয় বাসিন্দা ও সংবাদকর্মী জাহেদুল ইসলাম জানান, মাদকের তকমা দিয়ে তার এলাকায় প্রদীপ কুমার দাশ ১৬ জনকে হত্যা করেছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার প্রায় সবাই নিরীহ ও নিতান্তই গরিব।এসব পরিবারের সদস্যরা এখন প্রদীপের ফাঁসি যেন নিশ্চিত হয় এ জন্য রোজা রাখছেন বলে জানতে পেরেছি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, টেকনাফের কয়েকশো নির্যাতিত পরিবার প্রদীপ ও তার সহযোগীদের ফাঁসি চেয়ে গত কয়েকদিন ধরে রোজা রাখছেন। তাদের কামনা সিনহা হত্যায় যেন প্রদীপ ও তার সহযোগীদের ফাঁসির রায়।
নির্যাতিত পরিবারের সদস্যরা বলছেন, মেজর সিনহা হত্যার মধ্য দিয়ে টেকনাফে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হয়েছে। তাই সিনহা হত্যায় প্রদীপের ফাঁসির রায় হলে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।
আদালত সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি (টেকনাফে দুটি, রামুতে একটি) মামলা করে।
ঘটনার পাঁচ দিন পর ৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। চারটি মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব।
২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও র্যাব-১৫ কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম। মামলায় ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হলেও ৬৫ জনের সাক্ষ্য নিয়েছে আদালত।
আসামিরা হলো- পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল-মামুন, মোহাম্মদ মোস্তফা, এপিবিএন এর তিন সদস্য এসআই মোহাম্মদ শাহজাহান, কনস্টেবল মোহাম্মদ রাজীব ও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, পুলিশের মামলার তিন সাক্ষী নুরুল আমিন, নেজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজ, টেকনাফ থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মা এবং সাবেক এএসআই সাগর দেব। আসামিরা সবাই বর্তমানে কক্সবাজার কারাগারে রয়েছে।
এদিকে আলোচিত এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষে গত ১২ জানুয়ারি মামলায় উভয়পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শেষ করেন। যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের শেষে আদালত ৩১ জানুয়ারি মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন।