তদন্তের নামে হয়রানি নয়, নিখোঁজদের ফিরে পেতে অনুসন্ধান করুন
তদন্তের নামে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের স্বাক্ষর নেয়া থেকে শুরু করে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। এদিকে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগকে মিথ্যা এবং অতিরঞ্জিত বলে মানবজমিনকে জানিয়েছেন পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলেন, এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাছাড়া পুলিশ খোঁ নিলেও এটা তাদের একটি রুটিন ওয়ার্ক এবং তদন্তের অংশ। এদিকে গুমের শিকার ভিকটিম পরিবারগুলোর প্রতি তদন্তের নামে পুলিশি হয়রানি বন্ধে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় ‘মায়ের ডাক’-এর ব্যানারে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া প্রত্যেকের হাতে ছিল নিখোঁজ স্বজনের ছবি। কারও কাছে সন্তানের ছবি, কারও বুকে বাবার এবং আবার কারও বুকে ভাইয়ের ছবি। অনুষ্ঠানে নিজেদের দুঃসহ কষ্টের কথা তুলে ধরেন স্বজনরা।
নিখোঁজদের কারও সন্তান, মা, কারও বোন ঘটনার বর্ণনা দেন।
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। ২০১৪ সালের ১১ই জানুয়ারি লাকসাম যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন আলমগীর মোল্লা। নিখোঁজ আলমগীর মোল্লার বাবা শাহজাহান মোল্লা বলেন, গত ১০ই জানুয়ারি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং একজন উপ-পরিদর্শক তাদের লক্ষ্মীপুরের বাড়িতে আসেন। এ সময় তার ছেলে কীভাবে গুম হয়েছে এবং কোথায় মামলা করেছেন এসব জানতে চান। তিনি বলেন, পরবর্তীতে ওইদিন আমাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর গত ১২ই জানুয়ারি কীভাবে গুম হয়েছে পুরো ঘটনা কম্পিউটারে কম্পোজ করে সেটার একটি প্রিন্ট কপিতে আমার স্বাক্ষর নেয় পুলিশ। এ সময় পুলিশ বলে, একটা সাধারণ চিঠি লিখলেও তো আপনাকে স্বাক্ষর করতে হতো। এটা কোনো বিষয় না। লেখার নিচে এভাবে পুলিশ স্বাক্ষর নিয়ে নেয়। এ সময় ওই কাগজের একটি কপি চাইলেও পুলিশ তাকে দেয়নি বলে জানান আলমগীরের বাবা।
২০১৩ সালের ৭ই ডিসেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জ থেকে ২৭ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া সবুজবাগ থানা ছাত্রদল নেতা মাহবুব সুজনকে। তার ভাই জাহিদ খান শাকিল কান্নারত অবস্থায় বলেন, গত ১০ই জানুয়ারি বিকালে আমাদের বাসায় পুলিশ আসে। এসময় আমাকে থানায় যেতে বলা হয়। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে সন্ধ্যা ৭টায় আমি থানায় যাই। এ সময় পুলিশ একটি স্টেটমেন্ট লিখে বলেন, এখানে আপনার বাবার একটি স্বাক্ষর লাগবে। এ ছাড়া আপনারা পুরো লেখাটি হাতে লিখে নিচে স্বাক্ষর করবেন। এ সময় আমার সঙ্গে রাত সাড়ে ১০টায় একজন পুলিশ সদস্য বাসায় আসেন। ওই লেখাটিতে গুম হওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল না। লেখাটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে ‘সে (সুজন) নিজেই আত্মগোপন করে আছে’। একটি দায়সারা লেখা। যেটা অনেকটা জবানবন্দি প্রকৃতির লেখা ছিল। এ সময় আমার বাবা স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালে, থানা থেকে মুঠোফোনে পুলিশ খুব বাজে ভাষায় গালিগালাজ করে। তার অকথ্য কথাবার্তা বাসার বৃদ্ধ বাবা-মা এবং শিশুরা পাশ থেকে শুনছিলেন। এরপর প্রায় গভীর রাতে আরও ৭-৮ জন পুলিশ বাসায় আসে এবং তারা সর্বোচ্চ মাত্রায় দুর্ব্যবহার করেন। এ সময় আমার মা খুব কাঁদছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, পুলিশ কাগজে লিখিয়ে নিতে চান, উনি (গুম হওয়া ব্যক্তি) হারিয়ে গেছেন। পুলিশ কাগজে সই নিয়ে করবে কি? তার মানে কাগজ তার (পুলিশ) কোথাও দেখাতে হবে, ‘আমরা কিন্তু গুম করিনি, এটা ওনারই দোষ’। কোনো মামলা হয়েছে পুলিশের নামে? কোনো কোর্টে হয়েছে কিনা জানি না। কিন্তু সাধারণত এই রকম ডকুমেন্টস আসামিরা বানাবার চেষ্টা করেন। পুলিশকে এই সরকার আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। গুম হওয়া ৬-৭ শ’ মানুষের পরিবার থানায় ফরিয়াদ করতে গেলে তা পুলিশ নেয়নি। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে এটা নিয়ে কথা বলা হয়েছে। গুম হওয়া মানুষগুলোর আমরা খবর চাই। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, সরকারের যে এখন মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা সেটা খুব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। আজকে আন্তর্জাতিক শক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে তাদের সমর্থনে ফাটল ধরেছে। সেই ফাটলের ভয়ে ভীত হয়ে এখন তারা রাষ্ট্রশক্তিকে পুনরায় ব্যবহার করতে চাইছে সাধারণ মানুষের ওপরে। যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করার কথা সেই বাহিনীকে দিয়ে মানুষকে গুম করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। গুম-ক্রসফায়ারের নামে বিনা বিচারে মানুষ হত্যার জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের প্রত্যেককে বিচারের মুখোমুখি করুন।
রাজধানীর বংশাল এলাকা থেকে পারভেজের স্ত্রী ফারজানা বলেন, ২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বর আমার স্বামীসহ আরও চারজন নিখোঁজ হয়। সম্প্রতি গত ৯ই জানুয়ারি রাত সাড়ে ৯টায় বংশালে আমার শ্বশুরবাড়িতে এক আওয়ামী লীগের নেতাসহ পোশাক পরিহিত একজন এবং পোশাক ছাড়া বেশ কয়েকজন পুলিশ আমাদের বাসায় আসে। আমার শাশুড়িকে বলেন, আপনার ছেলে কোথায়?
এ সময় আওয়ামী লীগের ওই নেতা পুলিশকে বলেন, পারভেজের স্ত্রী জানেন পারভেজ কোথায় আছেন। এখন প্রায় নিয়মিত আমাদের বাসায় পুলিশ আসে। আমার শাশুড়িকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে শাশুড়ির ফোন থেকে আমাকে ফোন দেয় পুলিশ। আমাকে একাধিকবার ফোন করে বংশাল থানায় দেখা করতে বলে। আমি যেতে অস্বীকার করলে আমাকে পুলিশ পাল্টা প্রশ্ন করেন, আপনাকে কে আসতে নিষেধ করেছে? কার নির্দেশে আপনি চলেন? এ সময় পুলিশ রেস্টুরেন্টে দেখা করতে বলে। এভাবে প্রতিনিয়তই আমাদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এর কিছুদিন আগেও আমাদের বাসায় গিয়ে আমার শাশুড়িকে তদন্তের কথা বলে একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে বললে তিনি পড়ালেখা জানেন না বলে স্বাক্ষর এড়িয়ে যান। বর্তমানে বাবার বাসায় অবস্থান করলেও দুই সন্তানকে নিয়ে আতঙ্কে দিন পার করছেন পারভেজের স্ত্রী। তিনি বলেন, বাসার বাইরে একা বের হতে ভয় পাচ্ছি। আমার জীবন শেষের দিকে হলেও আমার বাচ্চাদের জীবন তো মাত্র শুরু। আমার কিছু হলে ওদের কি হবে?
বসুন্ধরা এলাকা থেকে নিখোঁজ হওয়া শিক্ষার্থী মাজহারুল ইসলাম রাসেলের পরিবারের এক সদস্য জানান, তেজগাঁও থানা থেকে গত ১০ই জানুয়ারি আমাকে সম্প্রতি ফোন দিয়ে আমার ছেলে সম্পর্কে নতুন করে বিস্তারিত তথ্য নেয়। এ সময় আমার ছেলের বিষয়ে প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র ই-মেইল করতে বলেছে পুলিশ। ই-মেইল করেছি। আমাকে এখন পর্যন্ত সই দেয়ার বিষয়ে থানা থেকে কিছু বলেনি। আর বললেও আমি কোনো মিথ্যা সই করবো না। কোনো সই আমি দিবো না। কোনোভাবেই দিবো না। আপনাকে কোনো চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের নতুন করে আর কি চাপ দিবেন তারা। আমি কি এখন কম চাপে আছি। নিখোঁজ কাওসারের স্ত্রী বলেন, গত তিন-চারদিন আগে আমাদের বাসায় তেজগাঁও থানার পুলিশ আসে। এ সময় জানতে চাওয়া হয় আমার স্বামী সত্যিই কি গুম হয়েছেন? না অন্য কোথাও লুকিয়ে আছেন। আমরা কেন সাধারণ ডায়েরি করিনি জানতে চায় পুলিশ।
পুলিশকে বলি, আমার স্বামীর নিখোঁজের বিষয়ে একাধিকবার থানায় গেলেও পুলিশ কোনো অভিযোগ গ্রহণ করেনি। এখন কিসের সাধারণ ডায়েরি করবো। এ সময় আমার একটি ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি নেয় এবং আমাকে ঠিকানা লিখে দিতে বললেও আমি লিখিনি। তিনি বলেন, ওই রাতেই আবার পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফোন দিয়ে আমাকে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে। পরদিন পুনরায় ফোন দিয়ে আমাকে থানায় আসতে বলেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার আমাকে ফোন দেন। আশঙ্কা প্রকাশ করে কাওসারের স্ত্রী বলেন, বর্তমানে আমরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি। ২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর নাখালপাড়ার বাসা থেকে কাওসারকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়। গুম হওয়া মো. সুমনের বোন বলেন, পুলিশ তদন্তের নামে আমাদের ওপর যে হয়রানি করছে- এটা বন্ধ হোক। তারা সুষ্ঠু তদন্ত করুক এবং নিখোঁজদের ফেরত পেতে যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন তারা তা করুক বলে জানান তিনি। ২০১৯ সালের ১৯শে জুন কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন বাতেনকে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে র্যাব-৪ তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করে তার পরিবার।
ইসমাইল হোসেন বাতেনের স্ত্রী নাসিমা আক্তার স্মৃতি বলেন, বাচ্চারা জিজ্ঞেস করে, সবার তো বাবা আছে, তাদের বাবা নেই কেন। আমি উত্তর দিতে পারি না। আমার স্বামীর মরদেহটা অন্তত দিন। তাকে মাটি দিয়ে আমরা একটু মিলাদ পড়াতে চাই। আর বেঁচে থাকলে আমাদের জানান তিনি কোথায় আছেন? নাসিমা বলেন, আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আমি পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। জিডি পর্যন্ত নেয়া হয়নি। অথচ হঠাৎ করে ৩ বছর পর পুলিশ প্রশ্ন করে, আমার স্বামী গুম হয়েছে এটা সত্য না মিথ্যা? আমাদের আবেগ, চোখের পানি নিয়ে সরকারের দায়িত্বরতরা ঠাট্টা করেন। হেসে হেসে তারা বলেন, আমাদের স্বজনরা বিয়ে করে অন্য কোথাও চলে গেছেন। এটা কেমন বিচার আপনাদের।