ছিনতাইকারী সন্দেহে কলেজছাত্রকে পিটিয়ে জখম: ফাঁড়িতে বসিয়ে রাখল পুলিশ, রক্তক্ষরণে মৃত্যু

0

মনিরামপুর উপজেলায় মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মারধরে মারাত্মক জখম কলেজছাত্র বোরহান কবিরের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে।

মায়ের অভিযোগ, রক্তাক্ত অবস্থায় বোরহানকে পুলিশ ফাঁড়িতে দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখায় তার মৃত্যু হয়েছে। শনিবার রাজগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়িতে এ ঘটনা ঘটে। তবে পুলিশ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

মঙ্গলবার বোরহানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার মৃত্যুতে গোটা পরিবার ভেঙে পড়েছে। বিলাপ করে বোরহানের মা রঞ্জু বেগম বলছেন, ‘আমার সোনারে (ছেলে) ওরা চিকিৎসা না করিয়ে হাতকড়া পরিয়ে ফাঁড়িতে বসিয়ে রাখে। এ কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। সে কয়েকদিন ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিল। তার চিকিৎসাও চলছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘সোনারে পড়ানোর জন্য সেলাই সেন্টারে আমি কাজ করছি। আমার সোনার ইচ্ছা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার। সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না।’ রঞ্জু বেগম জানান, শনিবার মোটরসাইকেল ছিনতাইকারী সন্দেহে বোরহানকে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করে স্থানীয় কয়েকজন। এরপর তাকে রাজগঞ্জ-হেলাঞ্চি সড়কের উপর ফেলে রাখা হয়।

খবর পেয়ে পুলিশ তাকে হাতকড়া পরিয়ে রাজগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে দুই দেবর নাইম ও রিকনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ফাঁড়িতে যান। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে দেখতে পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে নিতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। তিনি বলেন, বোরহান মানসিক রোগী এবং তার চিকিৎসা চলছিল। এ কথা বলায় এসআই তপন কুমার নন্দী এর প্রমাণ চান।

এরপর ১২ কিলোমিটার দূরের বাড়ি থেকে তার চিকিৎসার কাগজপত্র এনে দেখানো হলে তাকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। অভিযোগ করে তিনি বলেন, বিনা চিকিৎসায় তাকে দীর্ঘক্ষণ সেখানে বসিয়ে রাখায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে।

স্থানীয় চিকিৎসক সিরাজুল ইসলাম জানান, শনিবার বেলা ১১টার দিকে এসআই তপন তাকে (সিরাজুল) ফাঁড়িতে ডেকে নেন। সেখানে হাতকড়া পরানো ও মাথায় ব্যান্ডেজ করা বোরহানকে তিনি দেখতে পান। তার মাথার ব্যান্ডেজটি রক্তে ভেজা ছিল। ব্যান্ডেজটি তিনি পালটে দেন।

একই সঙ্গে তাকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর অনুরোধ করেন। মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক সুমন নাগ বলেন, বোরহানকে শনিবার বেলা ১টার দিকে ভর্তি করা হয়। তার শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় যশোর জেনারেল হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়।

অভিযোগ প্রসঙ্গে রাজগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ তপন নন্দী বলেন, খবর পেয়ে তারা রক্তাক্ত অবস্থায় বোরহানকে উদ্ধার করে ফাঁড়িতে নিয়ে যান। এ সময় মোটরসাইকেল ছিনতাইয়ের অভিযোগকারী হাদিউজ্জামান নাঈমকেও তারা ফাঁড়িতে নিয়ে যান। বোরহানের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য তার পরিবারের লোকজন স্থানীয় চিকিৎসক সিরাজুল ইসলামকে ডেকে আনেন।

রক্ত বন্ধ করতে তিনি সেলাই দেন। সেলাই দিতে যতক্ষণ সময় লাগে, ততক্ষণ মানে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মতো তাকে ফাঁড়িতে রাখা হয়েছিল। এরপর তাকে পরিবারের কাছে দেওয়া হয়। মারধরের ঘটনায় একজনকে আটক করা হয়েছে। মামলাও হয়েছে। তিনি আরও বলেন, হাতকড়া পরিয়ে ফাঁড়িতে দীর্ঘ সময় বসিয়ে রাখার অভিযোগ সঠিক নয়। দুর্ঘটনা ঘটলে পরিচয় না জানলেও তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।

রাজগঞ্জ ফাঁড়ির ইনচার্জ শাহজাহান আহমেদ বলেন, বোরহানের পরিবারের অভিযোগ ভিত্তিহীন। তার সঙ্গে মানবিক আচরণ করা হয়েছে। মনিরামপুর হাসপাতালে পাঠানোর পর তার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবরও নেওয়া হয়েছে।

খালিয়া গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় দোকানদার হাবিবুর রহমান জানান, সাগরা-কৃষ্ণবাটি গ্রামের নুর ইসলামের ছেলে নাইম তার মোটরসাইকেল ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেছিল বলে বোরহানকে লাঠি দিয়ে মারধর করে। এরপর তাকে রাস্তার পাশে খেতে ফেলে রাখে। সেখানে আরেক যুবক বোরহানকে মারধর করে। এরপর রাজগঞ্জ ফাঁড়ির পুলিশ বোরহানকে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, নাইমকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব বেরিয়ে আসবে।

বোরহানের নানা হামিদুল হক বলেন, তার নাতি বোরহান মেধাবী ছাত্র ছিল। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ‘এ’ প্লাসসহ বৃত্তি পেয়েছে। এসএসসিতে ইসলাম ধর্ম ব্যতীত সব বিষয়ে ‘এ’ প্লাস পায়। মনিরামপুর সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে সে ভর্তি হয়।

নিজের খরচ জোগাতে টিউশনি করত বোরহান। হাসপাতালে না পাঠিয়ে হাতকড়া পরিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় ফাঁড়িতে বসিয়ে রাখার বিষয়টি কিছুতেই তিনি মেনে নিতে পারছেন না। জানা গেছে, বোরহানের বাবা আহসানুল কবির সংসারের হাল ধরতে এবং সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে ট্রেগার (ইঞ্জিনচালিত যানবাহন) চালানোর পাশাপাশি অন্য কাজও করেন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com