২৭ বছরে ধরে ঝুলে আছে বাবরি মসজিদ ভাঙার মামলা
ভারতের অযোধ্যায় বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানের মালিকানা নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট বহুপ্রতীক্ষিত রায় ঘোষণা করেছেন। কিন্তু সেই জমির ওপর একসময় দাঁড়িয়ে থাকা বাবরি মসজিদ ভাঙার মামলা এখনও নিম্ন আদালতে ঝুলে আছে। দীর্ঘ ২৭ বছরেও শেষ হয়নি বাবরি মসজিদ ভাঙা মামলার তদন্ত কাজ।
১৯৯২ সালে বিজেপির তখনকার শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে হিন্দু করসেবকরা ওই মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। সেই ঘটনায় এখনও কোনো রায়ই আসেনি। ফলে সাজাও হয়নি কারও। এমনকি শুনানি শেষ করার জন্য সুপ্রিমকোর্টের বেঁধে দেয়া সময়সীমাও মানা হয়নি।
বিবিসি বলছে, এ পরিস্থিতিতে ভারতে এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, অযোধ্যার ওই জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ হলেও মসজিদ ভাঙার জন্য দোষীদের কি আদৌ কখনও সাজা হবে?
বাবরি মসজিদ ভাঙার ঠিক দশ মাসের মাথায় ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল প্রভৃতি সংগঠনের ৪০ জন শীর্ষ নেতাকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেছিল ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই।
তবে মসজিদ ভাঙার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগ থেকে ‘টেকনিক্যাল গ্রাউন্ডে’ অব্যাহতি দেয়া হয় লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলী মনোহর জোশীর মতো অনেক নেতাকেই।
১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে নরসীমা রাও সরকার গঠন করেছিল বিচারপতি এমএস লিবারহান নেতৃত্বাধীন তদন্ত দল। ২০০৯ সালে পেশ করা তাদের রিপোর্টে আদভানি, জোশী, কল্যাণ সিংসহ অন্যান্যদের দোষারোপ করা হয়।
দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর ২০১৭ সালে সুপ্রিমকোর্ট সেখানে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব আবার বহাল করে এবং লক্ষণৌ সেশনস কোর্টকে নির্দেশ দেয় কোনো বিরতি না নিয়ে একটানা এ মামলার শুনানি চালিয়ে যেতে হবে।
ফলে বাবরি মসজিদ ভাঙায় অভিযুক্তরা দীর্ঘদিন আইনের নাগাল এড়াতে পেরেছেন বলে জানিয়েছেন দিল্লির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মীরা ভাটিয়ার।
তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে আরও অনেক আগে এটা হওয়া উচিত ছিল। তবে এখন বিচার বিভাগ যে সক্রিয়তা দেখাচ্ছে, তাতে আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে যে ঝড়ের গতিতে এ মামলার শুনানি হবে এবং আমরা একটা নির্ণায়ক রায় পাব।’
লক্ষ্ণৌতে সেশনস কোর্ট অবশ্য সুপ্রিমকোর্টের বেঁধে দেয়া দুই বছরের ডেডলাইন মানতে পারেনি। ওই মামলার বিশেষ বিচারকের চাকরির মেয়াদও বাড়ানো হয়েছে।
সুপ্রিমকোর্টের সাবেক বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় বিবিসিকে বলেন, এ মামলায় এখনও সাজার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে ঠিকই কিন্তু বাবরি ভাঙাটা যে বিরাট এক অপরাধ সেটা ভারতের বিচার বিভাগ অনেক আগেই মেনে নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ১৯৯৪ সালে ইসমাইল ফারুকি মামলায় সুপ্রিমকোর্ট বলেছিল, বাবরি মসজিদ ভাঙাটা একটা ‘ন্যাশনাল সিন’ (জাতীয়পর্যায়ের পাপ)।
অশোক বলেন, ‘এখনও এ মামলায় শাস্তি হয়নি ঠিকই, কিন্তু চার্জশিট হয়েছে। মামলাটা এখন নিম্ন আদালতে বিচারাধীনও আছে।’
বস্তুত সেদিনের অপরাধটাও ছিল দু’ধরনের একদল ছেনি-হাতুড়ি নিয়ে মসজিদের কাঠামো ভেঙেছে। আর নেতারা পাশের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাদের উৎসাহ দিয়ে গেছেন। তবে সেই দ্বিতীয় অপরাধে অভিযুক্ত আদভানি- জাশী-উমা ভারতীর মতো বিজেপি নেতানেত্রীদের আজ পর্যন্ত কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি।
বছর দুয়েক আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকাকালীন উমা ভারতী তো রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা করেছিলেন, বাবরি মসজিদ ভেঙে তিনি কোনো অপরাধ করেছেন বলে মনেই করেন না।
দাম্ভিকের সুরে তিনি তখন বলেছিলেন, ‘কীসের ষড়যন্ত্র? সব তো খোলাখুলি হয়েছে। মনে যা ছিল, মুখেও তা বলেছি আর কাজেও তাই করেছি। রামমন্দির আন্দোলনে অংশ নিয়ে আমি চিরকাল গর্বিত বোধ করেছি। বাবরি মসজিদ ভাঙায় আমার কোনোদিন অনুশোচনা ছিল না। এজন্য আমি কখনও ক্ষমাও চাইনি।’
এখনও উমা ভারতীর অবস্থান হল ওই মামলায় তিনি বিচারের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত। এ ঘটনায় অভিযুক্ত লালকৃষ্ণ আদভানি সদ্য ৯৩ বছরে পা দিয়েছেন। মুরলী জোশীরও বয়স ৮৬ ছুঁইছুঁই।
এখন এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাদের জীবদ্দশায় সুপ্রিমকোর্টে বাবরি ভাঙার মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে এমন সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।