বেপরোয়া কিশোর গ্যাং
রাজধানীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং। শুধুমাত্র ঢাকার ১০টি থানা এলাকাতেই রয়েছে ৩২টি গ্যাং। এই গ্যাংয়ে সক্রিয় রয়েছে ৫৫০ সদস্য। এখনই এদের লাগাম টানা না গেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পুলিশের একটি সংস্থা। ওই সংস্থা একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে। ইতিমধ্যে এ প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে গ্যাং নিয়ন্ত্রণে ১২ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।
কিশোর গ্যাংগুলো তাদের সদস্য সংখ্যা বাড়াতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
খুলছে ফেসবুক পেইজ। তাদের মোটর রেস, উল্কি আঁকা, একসঙ্গে আড্ডা দেয়া, সড়কে জট বেঁধে মহড়া দেয়াসহ দল ভারির বিভিন্ন কার্যক্রম ফেসবুকে আপলোড করছে। এতে অন্য কিশোররাও এই গ্যাং পার্টির বিষয়ে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে ২৫শে মার্চের পর দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এ কারণে স্কুল ও কলেজগামী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার চাপ নেই। আবার অনেক কিশোর করোনার কারণে কর্মসংস্থান হারিয়েছে। তারাই পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে আড্ডা দিচ্ছে। ঘটাচ্ছে নানা অপরাধ।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) একেএম হাফিজ আক্তার জানান, কিশোর গ্যাং রোধে ঢাকা মহানগর পুলিশের বিট পুলিশিং কার্যক্রমকে জোরদার করা হয়েছে। ছোট গ্যাং হোক আর বড় গ্যাং হোক ঢাকায় কোনো গ্যাং পার্টি থাকবে না।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৪ মাসে ঢাকাসহ সারা দেশে কিশোর সন্ত্রাসীদের হাতে ১৩টি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটেছে। এতে সামাজিক অস্থিরতাসহ ওই এলাকায় বসবাসরত এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। পুলিশের অভিযান ও কিছু কিশোর গ্যাং সদস্যকে গ্রেপ্তার করার পরও এ চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ঢাকার সূত্রাপুর, ডেমরা, সবুজবাগ, খিলক্ষেত, কোতোয়ালি, উত্তরা পশ্চিম, তুরাগ, খিলগাঁও, দক্ষিণখান ও টঙ্গী থানা এলাকায় ৩২টি কিশোর গ্যাংয়ের ৫শ’ থেকে সাড়ে ৫শ’ সদস্য বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তারা মোড়ে মোড়ে আড্ডা দেয়ার পাশাপাশি তাদের মধ্যে ইন্টারনেটে অশ্লীল ছবি দেখার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা কখনো রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়, কখনো বড় মাপের সন্ত্রাসীদের ছত্রছায়ায় অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তাদের কারণে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে ছিনতাই, অপহরণ, এসিড নিক্ষেপের ঘটনায় কিশোরী-তরুণীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১লা এপ্রিল ঢাকার পাশের জেলা নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার আদর্শনগর এলাকায় ৩০ বছর বয়সী শরিফ হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গ্যাং কালচারের কারণে শরিফ মারা গেছে। গত ১০ই আগস্ট নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা কদমরসুল কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলাম ওরফে নিহাদ (১৮) ও বিএম ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র জিসান আহম্মেদকে খুন করে। ৮ই সেপ্টেম্বর সবুজবাগ এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বে জব্বার আলী নামে আরেক কিশোর খুন হয়। গত ২৭শে আগস্ট উত্তরখানের খ্রিস্টানপাড়া ডাক্তার বাড়ি মোড় এলাকায় সোহাগ নামে এক কিশোর খুন হয়।
প্রতিবেদনে সুপারিশে বলা হয়েছে, কিশোর গ্যাং ঠেকাতে সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে- এ ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে বলা হয়েছে অভিভাবকদের। খারাপ প্রকৃতির ছেলেদের সঙ্গে সন্তানকে না মেশার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশি করে খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করার কথাও বলা হয়েছে। সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ কিশোর গ্যাং নির্মূলে হটস্পট চিহ্নিত করে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করাসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানীয় রাজনীতিবিদরা যেন কিশোরদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করতে না পারেন সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং অভিভাবকদের। কিশোরদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এছাড়াও কিশোররা ইন্টারনেটে কী- ব্যবহার করছে তা অভিভাবকদের মনিটরিং করার পরামর্শ দেয়া হয়।