সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে দেশের অধিকাংশ মানুষ

0

সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে দেশের সাধারণ মানুষ। যাদের শিশু বা যুবতী মেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়াশুনা করে ওই সব পরিবার এখন চরম নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছেন। একের পর এক গণধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় অনেকেই ঘর থেকে বের হতেও ভয় পাচ্ছেন। ঘরে কিংবা ঘরের বাইরে রাস্তাঘাটে কোথাও নেই কোনো নিরাপত্তা।

অনেকেই বলছেন, পাড়া বা মহল্লার অলি গলিতে বখাটে ছেলেদের উৎপাত বেড়ে গেছে। বিশেষ করে মহল্লায় হাই স্পিডে চালানো বাইকারদের অনেকেই বখাটের খাতায় নাম লিখিয়েছে। মেয়েরা স্কুল-কলেজে যাওয়া-আসার পথে শিস দিয়ে উত্ত্যক্ত করে। কখনো কখনো প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে সাড়া না মিললে টার্গেটে পরিণত হচ্ছে। বিধবা মহিলারা একা বাড়িতে থাকলে বখাটে যুবকরা কুপ্রস্তাব নিয়ে হাজির হচ্ছে। তাদের ওই প্রস্তাবে রাজি না হলে গণধর্ষণ করে ফেলে রেখে যাচ্ছে, নয়তো হত্যা করছে। এসব ঘটনার নেপথ্য নায়করা স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকায় অধিকাংশ ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। দু’-একটা ঘটনা ভাইরাল হলেই কেবল অপরাধীরা আইনের আওতায় আসছে। কিছুদিন জেলহাজতে কাটিয়ে আবার বের হয়ে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

সচেতন মহলের অভিযোগ, ঘর থেকে নারীরা বের হলেই ধর্ষণ, হয়রানি ও লাঞ্ছিত হওয়ার আশঙ্কা তাড়া করছে। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে শিশুদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে। মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হলে মিলছে লাশ। বখাটেদের অপরাধের প্রতিবাদ করলেও ঘটছে নানা বিপত্তি। নিরপরাধ মানুষ হচ্ছে খুন, হয়রানি ও মামলা হামলার শিকার। আইনের জালে পড়ার ভয়ে অনেকেই প্রতিবাদও করে না। মুখ বুজে সহ্য করায় এতে পার পেয়ে যাচ্ছে বখাটেরা।

গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় স্বামীকে আটকে রেখে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্মম নির্যাতন চালায় এবং ভিডিও চিত্র ধারণ করে দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার ও তার সহযোগীরা। গত রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওই নারীর নগ্ন ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় দেশজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ওই ঘটনায় দেশ এখন উত্তাল হয়ে উঠেছে। গত সোমবার রাতে লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে এক বিধবাকে দলবেঁধে গণধর্ষণ করে হাত-পা ও চোখ-মুখ বেঁধে ঘরের পেছনে ফেলে পালিয়ে যায় এলাকার বখাটেরা। পরে ওই নারী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় হাসপাতাল থেকে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পথে দশম শ্রেণীর ছাত্রী নিলা রায়কে গত ২১ সেপ্টেম্বর চাকু মেরে হত্যা করে সাভারের বখাটে যুবক মিজান। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে ছাত্রলীগের বখাটেরা। ওই ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। গত রোববার জয়পুরহাট পৌর এলাকার হাজীপাড়া মহল্লার ১২ বছরের এক শিশুকে আখক্ষেতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে এলাকার বখাটে ফারুক। গত মঙ্গলবার মাগুরার শ্রীপুরে ভাতিজিকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় বখাটে শিহাব ও তার লোকজন চাচা মশিউর রহমানকে কুপিয়ে হত্যা করে। শুধু সিলেটের এমসি কলেজ, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ, মাগুরার শ্রীপুর, জয়পুরহাট কিংবা লক্ষ্মীপুরের রামগতি নয়, সারা দেশে এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি ভাইরাল হলেই কেবল নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। অধিকাংশ ঘটনাই প্রভাবশালীদের নানা হুমকি-ধমকি ও ভয়ভীতি দেখানোর কারণে এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুক্তভোগীরা প্রকাশ করতে সাহস পায় না।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত গত ৮ মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৮৯ জন নারী। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৯২ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪১ জনকে এবং ধর্ষণের পর লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন। এ ছাড়াও ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৯২ জনকে। গত মাসেও প্রায় একশতটি ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আর গত ৮ দিনে অর্ধশতাধিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এটা শুধুমাত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তৈরি করা সমীক্ষা। ধারণা করা হচ্ছে, গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়নি এমন সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি।

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, দেশে অবাধ যৌন স্বাধীনতার একটা চর্চা রয়েছে। বেশির ভাগ মানুষের ভেতরে কোনো নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠেনি। ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলার মানসিকতা এখনো তৈরি হয়নি। নাস্তিক্য মতবাদ ও পশ্চিমা সংস্কৃতি গ্রাস করছে। তা ছাড়া দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তো আছেই। আবার আইনের ফাঁক গলিয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। এসব কারণেই ধর্ষণের মত ঘৃণ্য অপরাধগুলো সংঘটিত হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আগে ধর্ষণকে একটি সামাজিক অপরাধ হিসেবে দেখা হতো। যার কারণে সমাজের কেউ এ ধরণের অপরাধ করলে এলাকার মাতব্বর, মেম্বার-চেয়ারম্যান ও আলেম-ওলামাদের সমন্বয়ে সালিশি বৈঠকের মাধ্যমে বিচার করা হতো। এখন সেই বিচার আর হয় না। আলেম-ওলামাদের ফতোয়া দেয়াতো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবক্ষয় হয়েছে।

বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব মো: গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া বলেন, প্রথমত, তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের দুর্নীতি ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে আওয়ামী লীগ। এই ব্যর্থতার কারণে তারা মনে করছে, অপরাধ করলেতো সাজা হবে না। ক্রমান্বয়ে তারা অপরাধ বেশি করছে। দেশে আইনের শাসন নেই। এ জন্য সমাজের মানুষ নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় হয়েছে, মানুষের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষার বড় অভাব রয়েছে।

আধুনিকতার নামে আমরা ধর্মীয় শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছি, তথাকথিত নাস্তিক্যবাদ আমাদের কাঁধে ভর করছে। দেশের সাহিত্য থেকে শিশুরা যৌন শিক্ষা নিচ্ছে। এতে তাদের মানসিকতার ওপর প্রভাব পড়ছে। এইসব থেকে মুক্ত হতে হলে দেশের সব পেশাশ্রেণীর মানুষকে সাথে নিয়ে রাষ্ট্রকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় অচিরেই আমরা একটি অসভ্য সমাজে পরিণত হবো।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com