প্রাণ ভিক্ষা চেয়েও পাননি, মা-বাবার সামনেই সন্তানকে পিটিয়ে হত্যা
‘পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বস্তু নাকি বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ। কোনো সন্তানকে যদি মা-বাবার চোখের সামনে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, তা কে সইতে পারে? সেই মা-বাবা কী নিয়ে বাঁচবে?’
বৃহস্পতিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন বৃদ্ধ আফাজ উদ্দিন। তিনি পেশায় একজন কুলি। গত সোমবার দুধ চুরির অভিযোগে খুন হওয়া রমজান আলী রাসেলের (২০) বাবা তিনি।
অভাব-অনটনের সংসারে রাসেলই ছিল প্রধান উপার্জনকারী। বৃদ্ধ আফাজ উদ্দিন এখন আর আগের মত বোঝা বইতে পারেন না। গত মাসে চাকরিটা ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন রাসেল। কিন্তু সংসারের বাকি পাঁচজনের দিকে তাকিয়ে তা পারেননি।
নগরের রিয়াজউদ্দিন বাজারের এসএস টাওয়ারের নিচে আরাফাত অ্যান্ড ব্রাদার্স নামে একটি দোকান রয়েছে। তৃতীয় তলায় ওই দোকানের গুদাম। গুদামে আচার, দুধের প্যাকেটসহ বিভিন্ন মালামাল থাকে। সেই গুদামে মালামাল আনা-নেয়ার কাজ করতেন রাসেল। সোমবার (২১ সেপ্টেম্বর) সেই গুদাম থেকে কিছু মালামাল চুরির অভিযোগে রাসেলকে তার মা-বাবার সামনে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
নগরের আইস ফ্যাক্টরি রোডে মা-বাবার সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকতেন রাসেল। বৃহস্পতিবার রাসেলের কুলখানি ছিল। এ দিন বিকেলে তাদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, রাসেলের মা বারান্দায় নির্বাক বসে আছেন। কয়েকবার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে কথা বলা যায়নি। কথা বলতে চাইছিলেন না রাসেলের বাবাও। একমাত্র কর্মক্ষম ছেলেকে হারিয়ে তারা যেন আজ বোবা।
বেশ কিছুক্ষণ পর রাসেলের বাবা আফাজ উদ্দিন বলেন, ‘আমার জাদুটা (রাসেল) সোমবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে দোকান মালিক আমাকে আর ওর মাকে মোবাইলে ডেকে নিয়ে যায়। তৃতীয় তলার গোডাউনে নিয়ে দেখি আমার ছেলেটাকে জানালার গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে চার-পাঁচজন মিলে পেটাচ্ছে। গোডাউনে ঢোকার সাথে সাথে দোকান মালিক আরাফাত সাঁটার নামিয়ে আমাদের আটকে ফেলে। এ সময় আমাদের হাত থেকে মোবাইলও কেড়ে নেয়।’
তিনি বলেন, ‘ছেলের এ অবস্থা দেখে আমরা দুজনেই কেঁদে উঠি। এ সময় তারা বলতে থাকে, তোর ছেলে গোডাউন থেকে দুধ চুরি করছে, ৭০ হাজার টাকা দিতে হবে। আমি গরিব মানুষ এত টাকা কীভাবে দেব, তাই কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। এদিকে আমার ছেলেকে ওরা মেরে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে ওরা আমাকে ও আমার স্ত্রীকেও লাথি-ঘুষি মারতে শুরু করে।’
আফাজ উদ্দিন বলেন, ‘তিন দফায় রাসেলকে মারধর করা হয়। সকালে দোকানে যাওয়ার পর থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত। আমরা ঘটনাস্থলে যাওয়ার পরে দ্বিতীয় দফায় ও বেলা ১টার পরে তৃতীয় দফায় মারধর করা হয়। এ সময় তাদের হাতে লাঠি, লোহার রড় ও বেলচা ছিল। মারধরের কারণে রাসেলের পা ও পিঠ ফেঁটে রক্ত ঝরলেও পাষাণরা মারধর থামায়নি। এ সময় যখন বুঝতে পারলাম ছেলেতো আর বাঁচবে না, তখন আমরা দুজন ওদের পায়ে পড়ে রাসেলের প্রাণ ভিক্ষা চাইলাম। কিন্তু ওদের কথা ছিল, টাকা না দিলে মেরে ফেলবে। সত্যি সত্যি ওই তারা আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলেছে। অথচ টাকা জোগাড়ের জন্য তার নানার বাড়িতেও ফোন দিয়েছিলাম।’
ওই দিন ঘটনাস্থলে আসা কয়েকজন পুলিশ সদস্য জানান, খবর পেয়ে রিয়াজউদ্দিন বাজারের একটি মেস থেকে রাসেলের লাশ উদ্ধার করেন তারা। মূলত মারধরের এক পর্যায়ে রাসেলের অবস্থা খারাপের দিকে যায়। পরে এসএস টাওয়ারের ৩য় তলার একটি মেসে নিয়ে যাওয়ার সময় তার মৃত্যু হয়। এই সময় রাসেলের বাবা-মা সঙ্গেই ছিলেন।
কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, মালামাল চুরি হলে ভুক্তভোগীরা আইনের আশ্রয় নিতে পারতেন। কিন্তু এভাবে কেউ আইন হাতে তুলে নিতে পারেন না। রাসেলকে মারধরের ঘটনায় দোকানের মালিক আরাফাত, তার ভাই আরমান, দোকান কর্মচারী ইউনুস, ভবন মালিক জসিম, পাশের দোকানের হারুন ও জাহাঙ্গির জড়িত ছিলেন। ঘটনার পর থেকে আরাফাত পলাতক রয়েছেন। পুলিশ আরমান, ইউনুস, জসিম ও জাহাঙ্গিরকে গ্রেফতার করেছে। মঙ্গলবার আদালত তাদের তিনদিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন। তাদের রিমান্ড শেষ হলে আদালতে সোপর্দ করা হবে।
এদিকে মালিক পক্ষের মারধরে রাসেলের মৃত্যুর প্রতিবাদে টানা কর্মসূচি পালন করছেন রিয়াজ উদ্দিন বাজার দোকান কর্মচারি সমিতি। তারা এ ঘটনার জন্য দায়ী আসামিদের ফাঁসির দাবি করেছেন।
আফাজ উদ্দিন বলেন, ‘আমি ওই অমানুষগুলোর কাছে ছেলের জীবন ভিক্ষা চেয়ে পাইনি। এখন দরকার হলে ভিক্ষা করেই ছেলের বিচার পেতে মামলা চালাবো। তারপরও আমার ছেলে হত্যার বিচার দেখে মরতে চাই।’