রডের বদলে বাঁশ দিয়ে শুদ্ধাচার পুরস্কার!
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শৌচাগার নির্মাণ প্রকল্পে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করে ৩৬০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া, অবৈধ সম্পদ অর্জন, চাকরিতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে জালিয়াতি—যাঁর বিরুদ্ধে এমন ১০টি অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), তিনিও পেয়েছেন সরকারের শুদ্ধাচার পুরস্কার। এই তিনি হলেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান। দুদক গত বছর থেকে সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো অনুসন্ধান করছে সেই সূত্রে জানা গেছে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা চাকরি জীবনেও অবিশ্বাস্য উন্নতি করেছেন। ১৪ মাসের ব্যবধানে তাঁর প্রধান প্রকৌশলী হওয়াকে রকেট গতির সঙ্গে তুলনা করেছেন অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে ১০টি অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মোনায়েম হোসেন। ২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সাইফুর রহমানের দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত চেয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন স্থানে চিঠি পাঠিয়েছেন তিনি। এসংক্রান্ত কিছু নথি একটি গণমাধ্যমের হাতে এসেছে।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৫ জুন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব জেসমিন পারভীনের সই করা এক চিঠিতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমান ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব ড. জুলিয়া পারভীন ও হিসাবরক্ষক ইমরান খান রনিকে শুদ্ধাচারের পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার বিষয়টি জানানো হয়।
শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়ার প্রক্রিয়ার খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে সরকার জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রয়োগের পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বিদ্যমান ধারণা বদলাতে এবং সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সরাসরি জবাবদিহির আওতায় আনার লক্ষ্যেই নেওয়া হয়েছে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল।
রকেট গতির পদোন্নতি
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে পদোন্নতি পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়, সেখানে সাইফুর রহমান অবিশ্বাস্যভাবে পেয়েছেন পদোন্নতি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীন একটি প্রকল্পে সহকারী প্রকৌশলী পদে দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে ১৯৮৯ সালে চাকরিতে যোগ দেন তিনি। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে তাঁর চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তর হয়।
দুদকে জমা হওয়া অভিযোগ অনুযায়ী, সাইফুর রহমান ফাউন্ডেশন ট্রেনিং ও বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষা না দিয়েই ২০১৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সহকারী প্রকৌশলী (ক্যাডার) পদে ক্যাডারভুক্ত হন। আর সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে ক্যাডারভুক্ত হয়ে মাত্র তিন মাসের মাথায় নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপর মাত্র সাত মাসের মধ্যে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পান। আর মাত্র ১২ দিনের মধ্যে ওই বছরের ৮ আগস্ট অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে চলতি দায়িত্ব পান তিনি। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে দায়িত্ব পাওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে গত বছরের ৪ নভেম্বর প্রধান প্রকৌশলী পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পান সাইফুর রহমন। এভাবে পদোন্নতি পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
পদোন্নতি প্রক্রিয়ার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদোন্নতির নিয়ম অনুযায়ী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে সহকারী প্রকৌশলী থেকে নির্বাহী প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পেতে কমপক্ষে সময় লাগে সাত বছর। এরপর নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হতে সময় লাগে কমপক্ষে পাঁচ বছর। তত্ত্বাবধায়াক থেকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হতে সময় লাগে দুই বছর। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী থেকে প্রধান প্রকৌশলী হতে সময় লাগে কমপক্ষে এক বছর। অর্থাৎ পদোন্নতির প্রক্রিয়ার বিধি অনুযায়ী একজন সহকারী প্রকৌশলীকে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী হতে কমপক্ষে সময় লাগে ১৮ বছর। কিন্তু সাইফুর রহমানের ১৪ মাসও লাগেনি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একাধিক জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, যাঁর চাকরির শুরুটাই ছিল অনিয়মে ঘেরা। সেই ব্যক্তি কিভাবে সহকারী প্রকৌশলী থেকে মাত্র ১৪ মাসের ব্যবধানে প্রধান প্রকৌশলী হয়ে যান সেটা নিয়ে অধিদপ্তরের সব কর্মকর্তাই বিস্মিত। ঠিকাদারদের একটি বড় চক্রকে কাজে লাগিয়ে তিনি রকেট গতিতে পদোন্নতি পেয়েছেন বলে মন্তব্য করেন তাঁরা। তাঁদের অভিযোগ, সাইফুর রহমানের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো বিধিবিধান মানা হয়নি।
রডের পরিবর্তে বাঁশ
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১২ সালে সারা দেশে ১৫ হাজার ৩৯৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৮ হাজার ৫৩৩টি শৌচাগার (ওয়াসব্লক) নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা), যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাসহ (ডিএফআইডি) সাতটি দাতা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৩) ওই প্রকল্পের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুর রহমান। দেড় হাজার কোটি টাকার ওই প্রকল্পের কাজের শুরুতেই বিভিন্ন জেলায় রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহারের হিড়িক পড়ে যায়।
ঘটনা-১ গাইবান্ধা সদর উপজেলার মেঘডুমুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শৌচাগার নির্মাণে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করা হয়। স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কর্মকর্তার সঙ্গে আঁতাত করেই ঠিকাদার রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করেন। ওই ঘটনায় জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী এ এস এম আরেফ বিল্লাহ ও ঠিকাদার আব্দুল খালেক সরকারসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৬ সালের ১৮ এপ্রিল গাইবান্ধা থানায় একটি মামলা করে দুদক। নীতিমালা অনুযায়ী বিভিন্ন ঢালাইয়ের কাজে ১০-১২ মিলিমিটার লোহার রড ব্যবহার করতে হবে এবং কাজ দিনে করার কথা। কিন্তু ঠিকাদার রডের পরিবর্তে চিকন বাঁশ ও বাঁশের কঞ্চি ব্যবহারের জন্য রাতের অন্ধকারে ঢালাইয়ের কাজ করতে গিয়ে রোষানলে পড়েন।
ঘটনা-২ বরগুনার আমতলী উপজেলায় বৈঠাকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শৌচাগার নির্মাণের ৩ বছরের মাথায় তা গত বছর ভেঙে পড়ে। তখন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ করা হয় যে সেখানে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছিল।
ঘটনা-৩ তিন বছর আগে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের সদপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শৌচাগার নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি নালার কাজে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করা হয়।
ঘটনা-৪ সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শৌচাগার নির্মাণে রডের পরিবর্তে গোপনে বাঁশের চটি ব্যবহার করা হয়।
শুধু বরগুনা, গাইবান্ধা, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ জেলায়ই নয়, সারা দেশের বেশির ভাগ স্কুলেই দুর্নীতি এবং অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্প কর্মকর্তা সাইফুর রহমানকে উেকাচ দিয়ে রডের পরিবর্তে বাঁশ দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়ম করে ৩৬০ কোটি টাকা কমিশন হিসেবে হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
দুদকে জমা হওয়া অভিযোগ থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সাইফুর রহমান সিএস অনুমোদন, তহবিল বরাদ্দ, সময় বর্ধিতকরণ, চূড়ান্ত বিল অনুমোদনসহ চারটি ধাপে প্রত্যেক ঠিকাদারের কাছ থেকে কাজের বিল থেকে ৯ পার্সেন্ট কমিশন হিসেবে আদায় করে হাতিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, গত বছর জুন মাসে প্রকল্প শেষ হয়। কিন্তু ছয় মাস পরে নেত্রকোনা, জামালপুর, নরসিংদী, সুনামগঞ্জ, পটুয়াখালী, কুমিল্লা, পাবনা, কুষ্টিয়াসহ অনেক জেলায় শতাধিক শৌচাগার নির্মাণের কাজ শুরুই হয়নি। কিন্তু ঠিকাদার কাজ শুরুর আগেই বিল তুলে নেন। মোটা অঙ্কের কমিশন পেয়ে বিল পরিশোধ করেন সাইফুর রহমান।
এর আগে সাইফুর রহমান যশোরে জেলা নির্বাহী প্রকৌশলীর পদে থাকাকালে আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সেখানে জাইকার একটি প্রকল্পের আওতায় দুই শ অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। কিন্তু ওই সব নলকূপের পানিতে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। এ ছাড়া অগভীর নলকূপকে গভীর নলকূপ দেখিয়ে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করেন তিনি। এ ক্ষেত্রে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। জাইকা ওই প্রকল্পের দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত কমিটি করে একটি প্রতিবেদন দেয়। সেই প্রতিবেদনে সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকল্পের দুর্নীতির টাকায় রাজধানীর আসাদগেটে (৩/১ আসাদ এভিনিউ, সেন্ট জোসেফ স্কুলের উত্তর পাশে) তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটসহ ঢাকায় তাঁর বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা, গাজীপুর ও পাবনায় নামে-বেনামে প্রায় ১০০ বিঘা জমির মালিক তিনি।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, সাইফুর রহমানের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে তথ্য জানার জন্য বিভিন্ন ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি পাঠানো হবে।
অভিযোগ অস্বীকার করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দুদকে আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ দেওয়া হয়েছে সেগুলো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে একটি মহল আমার বিরুদ্ধে নেমেছে।’