পাপিয়া সংশ্লিষ্টতা ছিল সেই জাহালমের
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভুলে তিন বছর জেল খাটা সেই মো. জাহালম বহুল আলোচিত বহিষ্কৃত যুবলীগ নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউয়ের সহযোগী ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পাপিয়ার কথিত বড় ভাই বিল্লালের বন্ধু জাহালম পাপিয়ার ফুটফরমায়েশ খাটতেন বলে দাবি করেছেন জাহালমের দ্বিতীয় স্ত্রী দাবিদার মোছা. মমতাজ। তিনি আরও বলছেন, দুদক আবু সালেক উল্লেখ করে জাহালমকে যে ৩৩টি মামলায় আসামি করেছে সেখানে অর্থের বিনিময়ে জাহালমের ছবি সরবরাহ করেন তারই বড় ভাই শাহীনূর। আর এর নেপথ্যে ছিলেন শাহীনূরের বন্ধু নাজির উর রহমান শুভ্র। তবে টাকার বিনিময়ে ভাইকে ফাঁসানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শাহীনূর। আর জাহালম পাপিয়ার সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন কি না সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। অন্যদিকে পাপিয়া সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে জাহালমের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
আট মাসের গর্ভবতী মমতাজ তার ছয় বছর বয়সী মেয়ে তাইয়্যেবাকে নিয়ে এখন মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। জাহালমের বিরুদ্ধে খোরপোষ ও কাবিননামার টাকা দাবি করে আদালতে মামলা করেছিলেন তিনি। মামলায় তার পক্ষে রায়ও এসেছে। গত বুধবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সঙ্গে কথা বলেন মমতাজ। এ সময় তিনি বলেন, জাহালমের পুরো নাম মো. জাহালম। বাবার নাম মো. ইউসুফ আলী ও মায়ের নাম মনোয়ারা বেগম। টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানার ধুবড়িয়ায় জাহালমের বাড়ি। জাহালম আগে নরসিংদীর ঘোড়াশালের বাংলাদেশ জুট মিলের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। ওই সময় তিনি পাপিয়ার ভাই পরিচয় দেওয়া বিল্লালের সঙ্গে মিলে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। বিল্লালের সঙ্গে মিলে পাপিয়ার জন্য বিভিন্ন কেনাকাটা করা এবং ঢাকা ও নরসিংদীর বাসায় এাঁ-ওটা নিয়ে যাওয়ার কাজ করতেন জাহালম। বিল্লাল ও পাপিয়ার অনেক অজানা তথ্য জানতেন জাহালম। তাছাড়া বিল্লাল তার অবৈধ অস্ত্র জাহালমের কাছে রাখতেন। বিল্লালের নামে নরসিংদীতে একশর বেশি মামলা আছে এবং তিনি দিনেদুপুরে মানুষ খুন করেন বলেও দাবি করেন মমতাজ।
মমতাজ বলেন, ‘সালেক নামে যে লোকের ছবি হিসেবে জাহালমের ছবি ও ঠিকানা দেওয়া হয়েছে সেটা আমার ভাশুর শাহীনূর টাকার লোভে জেনেশুনেই করেছেন। জাহালম যখন জেলে ছিল তখন আমার ভাশুর শাহীনূর আমার নবীনগরের বাসায় থাকতেন। সেখান থেকে তিনি নিয়মিত কোর্টে যেতেন। তখন শাহীনূর আমাকে বলেছেন, দোষ করলাম নিজে, নিজে বাঁচতে গিয়ে আমার অসহায় ভাইডারে বিপদে ফেললাম। আমার ভাশুরের বন্ধু নাজির উর রহমান শুভ্রকে আমার ভাশুর (শাহীনূর) জাহালমের ছবি ও ঠিকানা দিয়ে দেয়। সেই ছবি নিয়েই তারে (জাহালম) ফাঁসায়। তার ঠিকানা দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়।’
মমতাজ আরও বলেন, ‘আমি জাহালমের দ্বিতীয় স্ত্রী। তার আগের স্ত্রীর নাম কল্পনা। সেই ঘরে তার একটা মেয়ে আছে। আর আমার ঘরে তার এক মেয়ে আছে। আমি ৮ মাসের গর্ভবতী। আমার মা-বাবা নেই। মামার বাড়িতে বড় হয়েছি। আমি ছিলাম জাহালমের সম্বন্ধীর (স্ত্রীর বড় ভাই) বউ। জাহালম নানাভাবে প্রভাবিত করে আমার প্রথম স্বামীকে তালাক দেওয়ায়। পরে আমাকে বিয়ে করে। বিয়ের পর কিছুদিন সংসার করে আমার ওপর অত্যাচার নির্যাতন শুরু করে। আমি ঢাকা ইপিজেডে অ্যালায়েন্স স্টিকার্স নামে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতাম। আমার বেতনের টাকা ও জমানো টাকা-পয়সা জাহালম নিয়ে গেছে। আমাকে বাসা ভাড়া করে রাখার কথা বলে নরসিংদী নিয়ে বিল্লালের হাতে তুলে দেয়। সেখানে নরসিংদী রেল স্টেশনে বিল্লাল আমাকে মারধর করেছে।’
জাহালমের বিরুদ্ধে খোরপোষ ও কাবিননামার টাকা দাবি করে আদালতে মামলা করার পর তার পক্ষে রায় এসেছে উল্লেখ করে মমতাজ বলেন, ‘মামলায় আমার পক্ষে রায় এসেছে। মাসে তিন হাজার টাকা করে খরচ ও কাবিননামার দেড় লাখ টাকা দিতে বলেছে আদালত। জাহালম টাকা না দিতে পেরে আমার সঙ্গে আবার সংসার শুরু করে। সে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর কিছুদিন আমার সঙ্গে ছিল। এখন সে হাইকোর্টে ক্ষতিপূরণের মামলা করেছে। সে মনে করছে, অনেক টাকা পাবে। তাই এখন আর আমার খোঁজ নেয় না। আমি যোগাযোগ করলে বলে, ক্ষতিপূরণের টাকা পেলে সেখান থেকে আমাকে কিছু টাকা দেবে। আরও বলেছে, তুই গিয়া মরগা, গরিব মানুষ আল্লাও পছন্দ করে না।’
অশ্রুসিক্ত নয়নে জাহালমের দ্বিতীয় স্ত্রী আরও বলেন, ‘কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর জাহালম টেলিভিশন ও পত্রিকার সাংবাদিকদের কাছে বলেছে, তার একমাত্র সন্তান ছয় বছর বয়সী চাঁদনী। তাহলে তাইয়্যেবা কে? জাহালম কি তাইয়্যেবার বাবা না? আমার গর্ভে থাকা ৮ মাসের সন্তানের বাবা কে? জাহালম কেন আমাকে অস্বীকার করছে? আমি জাহালমকে ফোন করলে সে কথা বলে না, আমার ফোন ধরে না। আমি এখন কোথায় যাব?’
মমতাজের দেওয়া তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য জাহালমের মোবাইল ফোনে গত বুধবার দুপুরে কল করা হলে তার প্রথম স্ত্রী কল্পনা রিসিভ করেন। তিনি বলেন, ‘মমতাজ জাহালমের দ্বিতীয় বউ, এটা ঠিক আছে। তাইয়্যেবা জাহালমের মেয়ে। জাহালম ঈদের ৪-৫ দিন আগে ঢাকায় গিয়েছে। এখনো ফিরেনি।’
জাহালমের সঙ্গে পাপিয়ার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে কল্পনা বলেন, ‘জাহালমের বন্ধু ছিলেন পাপিয়ার ভাই বিল্লাল। কিন্তু এখন যোগাযোগ নেই।’
এদিকে টাকার লোভে ভাইকে ফাঁসানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শাহীনূর। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সঠিক নয়। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য।’
আর জাহালম পাপিয়ার সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন কি না সে প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘মমতাজ জাহালমের দ্বিতীয় স্ত্রী এটা ঠিক। কিন্তু সে দুশ্চরিত্রের মহিলা। সে আমাদের নামে বদনাম করে বেড়াচ্ছে। জাহালম নরসিংদীতে জুট মিলে কাজ করার সময় অনেকের সঙ্গে ওঠাবসা করেছে। পাপিয়ার সঙ্গে তার জানাশোনা ছিল কি না তা জানি না।’
২০১০ সালে জাহালমের ছবি ও ঠিকানা ব্যবহার করে আবু সালেক নামে এক ব্যক্তি সোনালী ব্যাংক থেকে সাড়ে ১৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এ ঘটনায় ২০১৪ সালে আবু সালেকের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। এরপর সালেককে তলব করে দুদক চিঠি দিলে সেই চিঠি পৌঁছায় জাহালমের টাঙ্গাইলের বাড়ির ঠিকানায়। জাহালম তখন দুদকে গিয়ে বলেন, তিনি আবু সালেক নন, সোনালী ব্যাংকে তার কোনো অ্যাকাউন্টও নেই। পরে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোড়াশাল থেকে জাহালমকে গ্রেপ্তার করে দুদক। তবে জাহালমের দ্বিতীয় স্ত্রী মমতাজের দাবি জাহালমকে সাভারের নবীনগরে তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করেছে দুদকের লোকজন। বিনাদোষে জাহালমের জেল খাটার বিষয়ে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলায় দুদকের ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। জাহালমকে ভুল আসামি করা ৩৩ মামলা পুনরায় তদন্ত করছে দুদক। কমিশনের কর্মকর্তাদের ভুলে জাহালম কারাভোগ করায় আদালতে তার পক্ষে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করেন আইনজীবীরা। সেটার শুনানি চলছে হাইকোর্টে।
পাপিয়ার ১১ নারী সহযোগীর খোঁজ মিলছে না : শামীমা নূর পাপিয়াকে গত বুধবার কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ৯ দিনের রিমান্ডে র্যাব-১ এর হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। র্যাব কর্মকর্তারা জানান, করোনা পরিস্থিতির কারণে রিমান্ড মঞ্জুর হওয়ার পরও তা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে রিমান্ড কার্যকরের জন্য আবেদন করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে বুধবার দুপুরে তাকে র্যাব হেফাজতে আনা হয়। দুদকের করা মামলার এজাহারে পাপিয়ার ওয়েস্টিনের আস্তানায় ১২ নারীসহ ১৯ জনের নিয়মিত যাতায়াতের কথা বলা হয়েছে। ওই ১২ নারী হচ্ছেন শেখ তায়্যেবা নূর, হাসি আক্তার, ফারহানা আক্তার, ডলি মীর, লায়লা আক্তার, মাহি, কান্তা আক্তার, সুমা হাসান, নূপুর, কোহিনূর বেগম, ফারিয়া ও আফরোজা। এদের মধ্যে তায়্যেবা নূর পাপিয়ার সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছেন। হাসি, ফারহানা, ডলী মীর, লায়লা আক্তার, মাহি, কান্তা আক্তার ও সুমা হাসানের জাতীয় পরিচয়পত্র ওয়েস্টিন হোটেলে জমা দেওয়া ছিল। দুদক অনুসন্ধানে জানতে পারে এর সবকটি পরিচয়পত্র ছিল ভুয়া। নরসিংদীর রায়পুর থানার ওসির তদন্তেও জাতীয় পরিচয়পত্রগুলো ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনেও এসব পরিচয়পত্রের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। পাপিয়ার সহযোগী এসব তরুণীর বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সফিউল্লাহ বুলবুল বলেন, ‘এখনো আমরা তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করিনি।’
আলোচিত ও বহিষ্কৃত যুবলীগ নেত্রী পাপিয়াকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি র্যাব ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে। একই সময় গ্রেপ্তার করা হয় পাপিয়ার স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী ওরফে মতি সুমন, তায়্যেবা নূর ও সাব্বির খন্দকারকে।