প্রণোদনার বদলে সাংবাদিকদের কপালে জুটেছে মামলা আর হয়রানি
১.
সাংবাদিক নঈম নিজাম ও পীর হাবিবুর রহমানের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে সরকার। নঈম নিজাম গতকালকে লিখলেন- ‘পরিণতির কথা ভাবি না, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলবই।’ আর আগের দিন সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান লিখলেন, ‘দুর্নীতিবাজ অপরাধীদের কাছে মাথা নত নয় পরিণতি যাই আসুক।’ ২.
স্বাস্থ্য খাতে ক্রমাগত দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই দুই সাংবাদিক তাদের পত্রিকায় ও সোস্যাল মিডিয়ায় সাম্প্রতিককালে লিখে যাচ্ছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও সেটা মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হতে শুরু করে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম নিজে করোনা আক্রান্ত হন। স্বাস্থ্য খাতে চরম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির চিত্রটি তিনি রোগী হয়ে এবার ভালো করেই দেখলেন। অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুরু থেকেই লিখে যাচ্ছেন পীর হাবিবুর রহমান। তাদের লেখাগুলোতে দু’জনেরই বড় প্রত্যাশা ছিল প্রধানমন্ত্রী হয়ত এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সজাগ হবেন। তাদের এই অভিযোগকে হয়ত আমলে নিবেন। স্বাস্থ্য খাতের বড় বড় দুর্নীতির গডফাদারদের বিরুদ্ধে হয়ত ব্যবস্থা নিবেন। কিন্তু দিনশেষে তারা নিজেরাই আজ সরকারি খড়গের শিকার। উনারা হয়ত ভেবেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই দেশের স্বার্থে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যাবেন। অথচ তাদের সব ভরসা, বিশ্বাস ও প্রত্যাশার জবাবে আজ তারা পেলেন সরকারি ফরমান!
৩.
উনারা এতটাই ভরসা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপর। ভরসাটা এতটাই দৃঢ় ছিল হয়ত খেয়ালই করেননি যে, দু’মাস আগে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল যে, ‘করোনাভাইরাস আক্রান্ত সময়ে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের উপর খড়গ নেমে এসেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই খড়গ এসেছে সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে।’
৪.
এদিকে সংবাদ মাধ্যমের জন্য আজকে সরকারি নিপীড়নই হয়েছে করোনার চাইতে বেশি ভয়াবহ। একদিকে নিউজরুমগুলোতে সরকারি চাপ ছাড়াও অর্থাভাব, চাকরিচ্যুতি ও করোনাভাইরাসের প্রভাবে সৃষ্ট মন্দাভাব এবং করোনায় সাংবাদিক মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যাও কম নয়। অন্যদিকে করোনাকালীন সময়ে সরকারি ত্রাণ বিতরণে লুটপাটের প্রতিবেদন প্রকাশের অপরাধে গত দুই মাসে অন্তত দেড় ডজন সাংবাদিক সরকারি দলের নিপীড়ন, নির্যাতন ও হুমকি-ধামকির মুখোমুখি হয়েছেন। এদের অনেকে মারাত্মক জখমও হয়েছেন। এদের মধ্যে ভোলার স্থানীয় সাংবাদিক সাগর চৌধুরী ও হবিগঞ্জে সাংবাদিক শাহ সুলতান আহমেদ মারাত্মকভাবে আহত হন। ঠাকুরগাঁও জেলার সাংবাদিক মো. আল মামুন, জাগো নিউজের সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকারসহ চার সংবাদকর্মী, নরসিংদীতে নিউজ ২৪ এর সংবাদদাতা হৃদয় খানসহ আরও দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তাদের সকলের একটাই ‘অপরাধ’ তারা ত্রাণচুরির সংবাদ প্রকাশ ও ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। তাদের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গুজব রটানোর মামলাও হয়েছে।
৫.
ত্রাণচোর ও চালচোরের বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে সাংবাদিকদের কপালে জুটেছে হামলা-মামলা, গ্রেফতার ও জেল-জুলুম। আর স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির বরপুত্রদের বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক ও নিবার্হী সম্পাদকের কপালে জুটেছে সরকারি খড়গ। সত্যিই বাংলাদেশে পত্রিকার স্বাধীনতা থাকলেও সাংবাদিকরা পরাধীন।
লেখক : ডক্টর তুহিন মালিক আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ।