ব্যাংক থেকে ঋণ বেশি নিলে শিল্প বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে
এক নাগরিক সংলাপ অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেছেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকার যদি বেশি পরিমাণ ঋণ নিয়ে নেয় তাহলে দেশে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা শিল্প চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।
তারা বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার বা বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সব ক্ষেত্রে দুর্নীতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। মঙ্গলবার রাজধানীতে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত এক ভার্চুয়াল নাগরিক সংলাপে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এসব কথা বলেন।
সুজনের সভাপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে নাগরিক সংলাপে অংশ নেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান ও বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব অধ্যাপক ড. শামসুল আলম। সংলাপটি সঞ্চালনা করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।
‘বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা সেক্টর থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে সরকার’- এমন একটি আভাসের বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, এটি মোটেও ঠিক হবে না।
তিনি মনে করেন, আগামী (২০২০-২১) অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য সর্বোচ্চ ৬০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করতে পারে। এর বেশি হলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে না। আর তখন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে।
ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করবে সরকার, তাও যেন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া হয়। কোনোভাবেই বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর এ চাপ সৃষ্টি করা যাবে না।
তিনি বলেন, বাজেটের আকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৮ শতাংশ, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য জিডিপির ১২ শতাংশ এবং বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৬ শতাংশ হতে পারে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তবে শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে দুর্নীতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। তা না হলে বাজেটের সুফল নাগরিকরা পাবেন না। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাজেটের আকার নয়, ব্যবহারেও জোর দিতে হবে। আর স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা, দেশীয় শিল্প, কৃষি, এসএমইসহ উৎপাদনমুখী খাতগুলোকে বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতে হবে। তাহলে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান দুটোই বাড়বে। এ মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ হল- করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনা, স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা বাড়ানো এবং অর্থনীতিতে যে মন্দা যাচ্ছে, তা কাটিয়ে টিকে থাকার ব্যবস্থা করা।
কোনোভাবেই দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে এখন যাওয়া যাবে না জানিয়ে তিনি বলেন, স্বল্পমেয়াদি প্রকল্পগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে বৃত্তের বাইরে গিয়ে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দিতে হবে। আগুন জ্বলছে, প্রথমে সে আগুন নেভাতে হবে। আগুন জ্বলছে স্বাস্থ্য খাতে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সে আগুন নেভাতে না পারলে বিকল্প ভাবা উচিত। ব্যক্তি খাতে অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান আছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেয়া যেতে পারে। অহেতুক, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে হবে।
বিশেষ করে বিলাসী ব্যয়, পর্যটন, ভ্রমণ, আপ্যায়নসহ ছোট ছোট এমন অনেক ব্যয় আছে যা চোখে পড়ে না কিন্তু সব এক করলে ব্যয়ের অংকটাও বড় হয়ে যায়। এসব অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে হবে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অর্থপাচার রোধে ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিং (পণ্যের দাম কম-বেশি ধরে অর্থ পাচার) বন্ধ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আরও শক্তিশালী করতে হবে। সম্পদ আহরণ বাড়াতে হবে। এর জন্য কর ফাঁকি ও খেলাপি বন্ধ করতে হবে। বাজেটে কৃষি খাত ও শ্রমঘন প্রকল্পকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে।
এম হাফিজ উদ্দিন আহমেদ খান বলেন, বিশ্বের কোথাও একপক্ষীয় বাজেট হয় না। বাজেটে জনসম্পৃক্ততা আগেও ছিল না। এখনও নেই। প্রস্তাবিত বাজেট প্রণয়নে কারও পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি। এখানে জনগণের মতামতের কোনো মূল্যায়ন নেই। তাই এ ধরনের বাজেট নাগরিকের কোনো কাজে আসে না।
ড. শামসুল আলম বলেন, আমরা একটা দুঃসময় পার করছি। সমস্যা সবার জানা। সরকারও বিষয়টি অবগত। অনেকে চাইছেন করোনায় পুরো দেশে লকডাউন ঘোষণা হোক। কিন্তু পুরো দেশ একসঙ্গে লকডাউন ঘোষণা করলে বিপর্যয় আরও বাড়বে। স্বাস্থ্য খাত প্রথমে কিছুটা ধাক্কা খেলেও দ্রুত সামলে নিয়েছে সরকার।
এর কারণ স্বাস্থ্য খাতের পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার প্রস্তুত ছিল না। সব মিলিয়ে বর্তমানে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়বে। এরপর কৃষি খাত গুরুত্ব পাবে। বড় প্রকল্পগুলোর কাজ চলবে। তবে যে সব প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা কম, সেগুলো বাজেটে গুরুত্ব পাবে না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন- দেশে দুর্নীতি, স্বজনপ্রতি, লুটপাট এবং দলবাজি মহামারী আকার ধারণ করেছে। যা করোভাইরাসের মহামারীকেও ছাড়িয়ে গেছে। এসব বন্ধ না করে বাজেটে বরাদ্দ দিয়ে কোনো লাভ নেই। এর সুফল মানুষ পাবে না।