স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ান দুর্নীতি কমান

0

আসছে ১১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থমন্ত্রী হিসেবে এটি তার জন্য দ্বিতীয় বাজেট। তার প্রথম বাজেটের তুলনায় আসন্ন অর্থবছরে আরও বড় আকারের বাজেট পেতে যাচ্ছি আমরা।

অর্থ মন্ত্রণালয়সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন বাজেটের আকার হতে যাচ্ছে ৫ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি। অন্য অর্থবছরের তুলনায় এবারের বাজেট পরিকল্পনার প্রধান পার্থক্য হল, গত ৫ মাস পৃথিবীজুড়ে নবাগত এক ভাইরাসের রাজত্ব।

পুরো বিশ্ব আজ মরিয়া হয়ে লড়াই করছে খালি চোখে অদৃশ্য করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশেও দিনের পর দিন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে শিল্প, বাণিজ্য, খাদ্য, শিক্ষা, ক্রীড়া, বিনোদন ও পর্যটনসহ প্রত্যেকটি খাতে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে সামনে উঠে এসেছে দেশের স্বাস্থ্য খাত।

করোনাভাইরাস এসে দেশের স্বাস্থ্য খাতের কঙ্কালসদৃশ নগ্নচিত্র সবার চোখে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে। রাজনীতিকসহ উচ্চবিত্ত শ্রেণি বিষয়টি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন। কারণ, সামান্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতেও যারা সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, লন্ডনে ছোটেন; অত্যন্ত গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায়ও আজ তারা বিদেশে যেতে পারছেন না। করোনা মহামারীর কারণে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলে যেমন কড়াকড়ি আরোপ হয়েছে, তেমনি প্রতিটি দেশ এখন নিজেদের রোগীদের চিকিৎসা দিতেই হিমশিম খাচ্ছে। তাই বাংলাদেশের অভিজাত শ্রেণির লোকজনকে বাধ্য হয়েই নিজের দেশে চিকিৎসাসেবা নিতে হচ্ছে।

করোনা মহামারী চিকিৎসা ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতার যে দিকগুলো তুলে ধরেছে, তার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে হাসপাতালগুলোয় গুরুতরভাবে অনুভূত হচ্ছে, হসপিটাল ফার্মাসিস্ট ও মাইক্রোবায়োলজিস্টদের প্রয়োজনীয়তা।

লোকবল সংকটের পরেই চোখে পড়েছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও স্বাস্থ্য উপকরণের অভাব। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে, লিকুইড অক্সিজেনের জন্য সেন্ট্রাল লাইন নেই ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ দেশের ৩৯টি সরকারি হাসপাতালে। সেভ দ্য চিলড্রেনের এক জরিপে দেখা যায়, সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ভেন্টিলেটরের সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ৭৬৯টি!

বিবিসির রিপোর্ট বলছে, মার্চ মাসের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ বেডের সংখ্যা ছিল মাত্র ১ হাজার ১৬৯টি। দেশে রিয়েল টাইম পিসিআর মেশিনের অভাবে করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণে জটিলতা পোহাতে হচ্ছে, নেই পর্যাপ্ত টেস্টিং কিট।

স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা সরঞ্জাম বা পিপিই সরবরাহও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তার ওপর করোনা চিকিৎসার চাপে এবং ভয়ে সাধারণ রোগীরাও বঞ্চিত হচ্ছেন স্বাস্থ্যসেবা থেকে। চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন অনেকে। এতে দেশে হাসপাতালের অভাবটিও নজরে পড়েছে। তৃতীয় যে সংকটটি চোখে পড়েছে তা হল, প্রশিক্ষণের অভাব। ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর নতুন রোগ ও নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে যেসব বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন, অনেক ক্ষেত্রেই তার ব্যবস্থা করা হয়নি। জনগণের স্বার্থে এসব সংকটের সমাধান করা সরকারের জন্য আশু প্রয়োজন। কারণ, স্বাস্থ্যসেবা হল মানুষের মৌলিক অধিকার। সবার আগে তাই স্বাস্থ্য খাতকেই গুরুত্ব দিতে হবে।

অতীতের বাজেটগুলোয় আমরা স্বাস্থ্যসেবা খাতকে অবহেলা করতে অথবা কম গুরুত্ব দিতে দেখেছি। এমনকি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দের হার ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ করা হয়েছিল। কিন্তু করোনা দুর্যোগ এসে বুঝিয়ে দিল, জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হয় সর্বাগ্রে। আমরা অনুধাবন করলাম, স্বাস্থ্যসেবাকে সব মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে।

শহর ও গ্রাম সর্বত্রই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে দেশের চিকিৎসাসেবা। এ জন্য ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোয়ও ন্যূনতম একজন করে এমবিবিএস ডাক্তার ও একজন করে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ করতে পারলে খুব ভালো হয়। আর এসব সংকট কাটাতে ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর বিকল্প নেই। আসন্ন বাজেটে তাই স্বাস্থ্য খাতকে দিতে হবে বিশেষ গুরুত্ব।

আবার বাজেট বরাদ্দ হলেই শুধু স্বাস্থ্য খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়; একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে বরাদ্দকৃত অর্থের যৌক্তিক ও স্বচ্ছ ব্যয়। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের পর্দা-কাণ্ড, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে মর্চুয়ারি ফ্রিজ-কাণ্ড, স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবরক্ষক আফজালের হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত অল্প কিছু ঘটনাতেই আঁচ করা গেছে, দেশের স্বাস্থ্য খাতে কতটা ‘সাগরচুরি’ হয়।

এমনকি করোনা দুর্যোগের সময়ও মানহীন ও ভুয়া এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ করার ঘটনাটি আমাদের জানান দেয়- দেশের সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতেও দুর্নীতিবাজরা থেমে নেই। তাই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতিকে কঠোরভাবে দমন করতে না পারলে স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের মানুষের কষ্টার্জিত আয়ে বসানো করের টাকায় এত অনিয়ম-দুর্নীতি চলতে দেয়া যায় না। এ জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দুর্নীতিমুক্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি তদারকি ও কঠোর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করি।

আসন্ন ২০২০-২১ বাজেটে মানুষের মৌলিক অধিকার ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে সেবার কলেবর ও মান বৃদ্ধির পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে বিরাজমান অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। তবেই আমরা সাধারণ জনগণ প্রাপ্য স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারব; ফেলতে পারব স্বস্তির নিঃশ্বাস।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com