লাগাম নেই খরচে
খরচের ক্ষেত্রে যেন কোনো ধরনের লাগাম নেই। প্রতিটি সেক্টরের উন্নয়ন প্রকল্পে খরচ হচ্ছে লাগামহীন। আর প্রকল্পগুলো যখন সংশোধনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের কাছে পাঠানো হয় তখন সেখানে ব্যয় প্রস্তাব থাকে মাত্রাছাড়া, বাস্তবতাবিবর্জিত। একই ধরনের প্রকল্পে একই কাজের ব্যয়ের বিশাল ফারাক।
কুষ্টিয়ার পদ্মা এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারার কর্ণফুলী-সাঙ্গু নদীর তীররক্ষার ব্যয়ে ব্যবধান প্রতি কিলোমিটারে ৫১ কোটি টাকা। আবার চট্টগ্রামের প্রকল্পের সংশোধনীতে হেক্টরপ্রতি জমির দাম ২.৫৬ কোটি টাকা এবং প্রতিটি পোল্ডার নির্মাণ ব্যয় ৩৫ লাখ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় চট্টগ্রামে ১০৬ শতাংশ বেড়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশনের সেচ উইং থেকে জানা গেছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনের কাছে নদীর তীররক্ষার দু’টি প্রকল্প পিইসি করার জন্য পাঠানো হয়। একটি নতুন এবং অপরটি দ্বিতীয় দফায় সংশোধনের মাধ্যমে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি সংক্রান্ত। পদ্মা নদীর ভাঙন থেকে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলাধীন তালবাড়িয়া এবং কুমারখালী উপজেলাধীন শিলাইদহ ইউনিয়নের কোমড়কান্দি এলাকা রক্ষার জন্য ৭৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি মূল্যায়ন কমিটি থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। এতে ৮ দশমিক ৫৩ কিলোমিটার নদীর তীর রক্ষা করতে ব্যয় হবে ৭২৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এখানে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ৮৫ কোটি ১১ লাখ টাকা। একইভাবে চট্টগ্রাম জেলার উপকূলীয় এলাকার পোল্ডার নম্বর ৬২ (পতেঙ্গা), পোল্ডার নম্বর-৬৩/১এ (আনোয়ারা), পোল্ডার নম্বর-৬৩/১বি (আনোয়ারা এবং পটিয়া) পুনর্বাসন (দ্বিতীয় সংশোধন) প্রকল্পের ব্যয় ২৮০ কোটি ৩০ লাখ টাকা থেকে দুই দফায় বেড়ে ৫৭৭ কোটি ২৪ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রকল্পে ১৩ দশমিক ৮০২ কিলোমিটার নদীর তীর রক্ষায় ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৮২ কোটি ৮৪ লাখ ১২ হাজার টাকা। এখানে কিলোমিটারে খরচ হবে ৩৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। কুষ্টিয়ার পদ্মার সাথে চট্টগ্রামে নদীর তীররক্ষা খরচের পার্থক্য দ্বিগুণেরও বেশি, ৫১ কোটি টাকা।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের চট্টগ্রামের প্রকল্পটিতে পিইসির বিশ্লেষণের তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালে নেয়া এ প্রকল্পটির অনুমোদিত ব্যয় ছিল ২৮০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুনে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে প্রথম দফায় সংশোধন এনে ব্যয় ৪০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। তাতেও প্রকল্প শেষ হয় না। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি হয় ৭০ শতাংশ, যা অর্জনে খরচ হয়েছে ৬৫ দশমিক ১৫ শতাংশ বা ২০৯ কোটি টাকা। এখন দ্বিতীয় দফায় এ ব্যয় ৮০.২২ শতাংশ বা ২৫৬.৯৪ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৫৭৭ কোটি ২৪ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এক বছর সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব রয়েছে।
কমিশনের সেচ উইংয়ের উপপ্রধানের পর্যালোচনার তথ্যানুযায়ী, প্রকল্পে প্রথমে ১১.৬৫২ কিলোমিটার নদীর তীর বা সি-ডাইক প্রতিরক্ষায় ব্যয় ২৫২ কোটি ৮ লাখ টাকার সংস্থান আছে, প্রতি কিলোমিটারে ২১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত ব্যয় ১৭০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এখানে প্রায় আড়াই বছরে এ খরচ। এখন সংশোধনীতে ১৩.৮০২ কিলোমিটার প্রস্তাব করে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৮২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। প্রতি মিটারে সাড়ে ৩ লাখ এবং কিলোমিটারে ৩৫ কোটি টাকা। ব্যয় বেড়েছে ১৩ কোটি টাকা।
একইভাবে ডিপিপিতে মোট ৩৫টি পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মাণ বা মেরামত বাবদ ২৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকার সংস্থান ছিল। প্রতিটির জন্য ৭৯ লাখ ১১ হাজার টাকা। ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১৫ লাখ টাকার একটু বেশি। দ্বিতীয় সংশোধনীতে বাড়িয়ে ৪০টি পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মাণ বা মেরামত বাবদ ৪৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এখানে প্রতিটিতে ব্যয় হবে এক কোটি ১৪ লাখ টাকা। ব্যয় বাড়ল প্রতিটিতে ৩৫ লাখ টাকা। কমানো হয়েছে ড্রেজিংয়ের ব্যয়।
তবে জমি অধিগ্রহণে ৫ হেক্টরের জন্য সংস্থান ছিল ২ কোটি ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। হেক্টরে খরচ ৪৭ লাখ ১০ হাজার টাকা। কিন্তু এখন সংশোধনীতে এসে অধিগ্রহণ প্রায় ২ হেক্টর কমলেও ব্যয় বেড়েছে চার গুণ। ৩.০২ হেক্টর জমির জন্য ব্যয় ৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা। প্রতি হেক্টরে ব্যয় হবে ৩ কোটি ৩ লাখ টাকা। এখানে হেক্টরে খরচ বাড়ল ২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাতে কোনো অগ্রগতি নেই। জমির পরিমাণ কমলেও ব্যয় এত বৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে।
এ দিকে সরকারের নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের মাধ্যমে অর্থের অপচয় করা হচ্ছে। গত জানুয়ারিতে একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী পানিসম্পদ সংশ্লিষ্ট বিশেষ করে নদীসংক্রান্ত প্রকল্প ভালোভাবে যাচাই করেই অনুমোদনের জন্য পেশ করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে পরিকল্পনামন্ত্রী জানান। উত্তরবঙ্গের দুই জেলার নদীর তীর সংরক্ষণ ও বাঁধ নির্মাণের জন্য নদী ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু এ নির্দেশনাগুলো মানা হচ্ছে না প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরিতে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড এ ব্যয় বৃদ্ধির ব্যাপারে বলছে, নদীতীর বা সি-ডাইক প্রতিরক্ষা কাজ, পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো মেরামত বা পুনর্বাসন এবং বনায়নের পরিমাণ বৃদ্ধি, রেট শিডিউল পরিবর্তনের কারণে কিছু প্যাকেজের মূল্য বৃদ্ধি, ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ কমলেও ব্যয় বৃদ্ধি, দরপত্রভুক্ত ও দরপত্রবহির্ভূত কিছু আইটেমের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণেই ব্যয় বাড়ছে।
এ ব্যাপারে বাস্তবায়নকারী সংস্থা পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক ও প্রধান প্রকৌশলীর সাথে গতকাল কয়েক দফা ফোনে যোগাযোগ করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। দু-একজন প্রকৌশলী বলেন, প্রকল্পটি আগামী বুধবার দ্বিতীয় সংশোধনীর জন্য পিইসিতে উঠবে।
ব্যয় বৃদ্ধির ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) মো: জাকির হোসেন আকন্দের জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, রেট শিডিউল পরিবর্তনের কারণে ব্যয় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। প্রথমে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ২০১৭ সালের রেট শিডিউল ধরে। এখন রেট শিডিউল ২০২০ সালের। আর জমির দাম জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে যে দর দেয়া হয় সে অনুযায়ী প্রাক্কলন করা হয়েছে। এখানে আমাদের করার কিছুই নেই।