আইসিইউ’র জন্য আহাজারি
রাবেয়া আক্তার (৫৬)। রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা। বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বর ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। পরে পরীক্ষায় করোনা ধরা পড়ে। রোগীর অবস্থা বেগতিক দেখে তার স্বজনরা করোনা চিকিৎসা দেয় রাজধানীর এমন বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরলেও একটি আইসিইউ পাননি তারা। এম্বুলেন্সে করে একটির পর একটি হাসপাতালে ঘুরলেও সবজায়গা থেকে তাদের না করে দেয়া হয়। পরে অ্যাম্বুলেন্সেই তার মৃত্যু হয়। এটি সপ্তাহখানেক আগের ঘটনা। ময়মনসিংহ শহরের কালীবাড়ী রোডের বাসিন্দা আঙ্গুর বণিক (৭০) কিডনিতে পাথর।
তার সন্তান সুজন বণিক অ্যাম্বুলেন্সে করে মাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। প্রথমে রাজধানীর কয়েকটি বেসরকারী হাসপাতালে ঘুরেন তারা। প্রায় সাতটি হাসপাতাল ঘুরার পর তাকে নেয়া হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। সেখানে ভর্তির পর তার অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। চিকিৎসকরা দ্রুত আইসিইউর ব্যবস্থা করতে বলেন কিন্তু বহু চেষ্টা করেও আইসিইউর ব্যবস্থা করা যায়নি। পরদিন সকাল ৯টার দিকে ঐ বৃদ্ধার মৃত্যু হয়। এভাবে রাজধানীসহ সারাদেশে রোগীর স্বজনার আইসিইউ খুঁজছেন হন্য হয়ে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সারাদেশে কোনো হাসপাতালেই করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ বেড খালি নেই। প্রতিদিন অসংখ্য রোগী বেড়ে যাওয়ায় এমন চাপে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল এই প্রতিবেদক পাঁচটি হাসপাতালে হট লাইনে ফোন দিয়ে জানতে পারেন, কোনোটিতেই খালি নেই আইসিইউও। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক মিনিটও খালি থাকে না আইসিউ। নিয়মিত অসংখ্য ফোন আসলেও সবাইকে তারা এই সুবিধা দিতে পারেন না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাকালে আইসিইউ নিয়ে টানা হেঁচড়ায় বেরিয়ে এসেছে দেশের স্বাস্থ্য খাতের এই দৈন্যদশা। এমন আক্ষেপের কথা জানিয়েছেন নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক। তিনি বলেন, পেশায় একজন চিকিৎসক হয়েও বাবার জন্য আইসিইউ খুঁজে পাচ্ছিলাম না কোথাও। এমনকি নিজে যে হাসপাতালে চাকরি করি সেখানেও না। পরে কোনোভাবে একটি হাসপাতালে আইসিইউ পেয়েছি। বাবার পরিস্থিতি বেশ সঙ্কটাপন্ন। গত এপ্রিলে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-চীন যৌথ প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনা আক্রান্ত পাঁচ শতাংশ রোগীর কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রয়োজন হয় এবং আরও ১৫ শতাংশের জন্য প্রয়োজন হয় ঘনীভূত অক্সিজেন। যার অর্থ প্রায় ২০ শতাংশ রোগীর আইসিইউ প্রয়োজন হয়। অথচ দেশে রোগীর তুলনায় ২০ শতাংশের ধারে কাছেও নেই দেশের আইসিইউ ব্যবস্থা। গত সপ্তাহে দেয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক হিসেবে জানা যায়, করোনা রোগীদের জন্য সারাদেশে মাত্র ৩৯৯ টি আইসিইও বেড রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে ২১৮ টি, ঢাকা বিভাগে ৪৭ টি, চট্রগ্রাম বিভাগে ৩৪, ময়মনসিংহ বিভাগে ৭টি,বরিশালে ১৮টি,সিলেট ১৬টি, রাজশাহীতে ২৮টি, খুলনায় ১৮টি,রংপুরে ১৩টি। খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, দেশে প্রায় ১৮টি জেলায় কোনো আইসিউ নেই। উপজেলা পর্যায়ে নেই বললেই চলে। আর যে পরিমান আইসিইউ রয়েছে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে তা মোটেও রোগিদের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না বলে অভিযোগ করছে সংশ্লিষ্টরা। শুধু তাই নয়, করোনা আক্রান্ত বেশীর ভাগ রোগীই মারা যাচ্ছে আইসিইউর অভাবে। তবে সরকারী হাসপাতালগুলো বাইরে ৭৩৭টি আইসিইউ বেড রয়েছে। এদিকে বিভিন্ন হাসপাতালে সবকিছু ঠিকঠাক হয়েও চালুর অপেক্ষায় আছে প্রায় চল্লিশটি আইসিইউ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেগুলোও আগস্টের আগে চালু করা সম্ভব না।
এদিকে জানাগেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনার জন্য নির্ধারিত সরকারি-বেসরকারি যেসব হাসপাতালে এখন সেবা দেয়া হচ্ছে সেগুলোতে আইসিইউ রয়েছে ১৪০টিরও কম। অথচ যেসব আইসিইউগুলো এখনো প্রস্তুত হয়নি সেগুলোকে হিসেবে ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়মিত ব্রিফিং করে যাচ্ছে। খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, এখনো প্রস্তুত হয়নি বিভিন্ন হাসপাতালের ৫০টি আইসিইউ বেড। জানা গেছে, মহানগর হাসপাতাল এবং মাতৃ ও শিশু হাসপাতালে মাসখানেক আগে ৫ শয্যার আইসিইউ স্থাপনের কাজ শুরু হয়। এখনো শেষ হয়নি কাজ। তারপরেও এই ১০টি আইসিইউকে তালিকায় দেখানো হচ্ছে নিয়মিত। মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালটিতে ১৬টি আইসিইউ রয়েছে বলা হলেও সেখানে রয়েছে ১৪টি। কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ২৬টি আইসিইউ রয়েছে। কিন্তু ওই হাসপাতালের দক্ষ জনবল না থাকার কারণে বেশ কয়েকটি আইসিইউ এখনো চালু করার সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। এদিকে গতকাল দেশের হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের জন্য কতটি আইসিইউ বেড রয়েছে তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে আগামী কালকের মধ্যে হটলাইনে দেয়া নাম্বারে ফোন করলে কোথায় আইসিইউ বেড খালি আছে তা জানানো হয় কিনা তাও জানাতে বলেছেন।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন(বিএমএ) এর মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, নতুন যে বেসরকারি হাসপাতালগুলো কোভিড-১৯ চিকিৎসায় যুক্ত হয়েছে তাদের আরো হয়তো সব মিলিয়ে ৫০ টি আইসিইউ আছে। রোগী বেড়ে যাওয়ায় আইসিইউর সংকট তৈরি হয়েছে। আগে থেকে পরিকল্পনা করলে হয়তো এই সংকট এড়ানো যেতো। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী সাধারণ হাসপাতালে মোট বেডের শতকরা পাঁচ ভাগ এবং বিশেষায়িত হাসপাতালে ১০ ভাগ আইসিইউ বেড থাকবে। আমাদের এখানে এর অনেক কম। ভেন্টিলেটর আছে আরো কম। যত আইসিইউ বেড তার ৪০ ভাগ বেডে ভেন্টিলেটর আছে।
আইসিইউ প্রশিক্ষত চিকিৎসক মাত্র ৩০ জন: দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সেভাবে প্রস্তুত হয়নি স্বয়ংসম্পূর্ণ আইসিইউ বেড ও দক্ষ জনবল। শুধুমাত্র দক্ষজনবল সংকটের কারণে অনেক আইসিইউ চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে দেশে ক্রিটিক্যাল কেয়ার বা জটিল রোগীর সেবার ওপর প্রশিক্ষিত চিকিৎসক মাত্র ৩০ জন। এই বিষয়ে নেই কোনো ডিগ্রিধারি নার্স। এ অবস্থায় সীমিত এ জনবল দিয়ে সারাদেশে আইসিইউ পরিচালনা অসম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা । তারা বলছেন , বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে ডিজিটাল সংযোগে ঢাকা থেকেই সারাদেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসদের মাধ্যমে আইসিইউ পরিচালনা সম্ভব। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য অধিকার কর্মী ডা. শারমিন আব্বাসি বলেন, আমাদের যে ৩০ জন আইসিইউ বিশেষজ্ঞ আছেন তার মধ্যে দুইজন আবার দেশের বাইরে আছেন। বাকীদের মধ্যে ১৫ থেকে ১৬ জন কাজ করছেন। জানা যায়, বছরে গড়ে ৩ জন করে চিকিৎসক ক্রিটিক্যাল কেয়ারের ওপর ডিগ্রি নেন। এটি প্রয়োজনের তুলনায় খুব অপ্রতুল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, শুরু থেকেই সরকার বলে আসছে যথেষ্ট প্রস্তুতি আছে। কিন্তু বাস্তবে কি হচ্ছে আমরা কিন্তু তা দেখতেই পাচ্ছি। দীর্ঘ সময় পেলেও সরকার প্রস্তুতিই শেষ করতে পারেনি। দু:খের বিষয় আমাদের এসব আইসিইউ কিছু থাকলেও সেগুলো আবার দক্ষজনবল দিয়ে পরিচালনা করার মতো সক্ষমতা নেই। আবার সংকটও চরম আকারে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও মিডিয়া সেলের ফোকাল পয়েন্ট মো. হাবিবুর রহমান খান বলেন,আইসিউ স্বল্পতা তো অবশ্যই। সরকারের চেষ্টা রয়েছে করোনা রোগীদের আইসিউ সংখ্যা বাড়ানোর জন্য। কিন্তু এই মূহুর্তে বিদেশ থেকে আমদানী করা একটু কষ্টসাধ্য। কিন্তু আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিছু আইসিইউ চালু না হওয়ার ব্যাপারে বলেন, দক্ষজনবল তো সংকট রয়েছে যার কারণে এমনটা হচ্ছে। তারপরও যে হাসপাতাল তাদের সংকটের কথা জানাচ্ছে তাদেরকেই আমি লোকবল দিচ্ছি।
দেশে আইসিইউয়ে বেডের সংখ্যা কত, জানতে চান হাইকোর্ট
দেশের হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের জন্য কতটি আইসিইউ বেড রয়েছে তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে আগামী বুধবারের (১০ জুন) মধ্যে হটলাইনে দেয়া নাম্বারে ফোন করলে কোথায় আইসিইউ বেড খালি আছে তা জানানো হয় কিনা তা জানাতে বলেছেন। সোমবার হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের ভার্চুয়াল বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
আদালতে গতকাল আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ইয়াদিয়া জামান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। আইনজীবী ইয়াদিয়া জানান, সারাদেশে আইসিইউ বেডের সংখ্যা কত, হটলাইনে দেয়া নাম্বারে ফোন করলে কোথায় আইসিইউ বেড খালি আছে তা জানানো হয় কিনা তা জানাতে বলেছেন আদালত। এর আগে গত রোববার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ডেপুটি রেজিস্ট্রার ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুনের পক্ষে আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইয়াদিয়া জামান বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) এই সময়ে দেশের সব বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ সরকারিভাবে অধিগ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে রিটটি দায়ের করেন । একই সঙ্গে করোনা মোকাবিলায় অনলাইনে সেন্ট্রাল বেড ব্যুরো চালুরও নির্দেশান চাওয়া হয়। সেন্ট্রাল বেড ব্যুরো’র ধারণাটি ব্যাখ্যা করে এই আইনজীবী বলেন, সারাদেশে কোন হাসপাতালে কয়টি বেড খালি আছে, কোথায় খালি নেই-তার সব তথ্য এক জায়গায় থাকবে। এ ব্যবস্থা চালু থাকলে রোগী ভর্তির আগেই স্বজনরা জানতে পারবেন, কোথায় বেড খালি আছে। এতে করে রোগী নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে না। রিটে স্বাস্থ্য সচিব, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সচিব এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট ছয়জনকে বিবাদী করা হয়েছে।