এটা কি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির দায়মুক্তির ভয়াবহ নজির নয়?
১.
মানব পাচার ও মানি লন্ডারিং অপরাধে আটক সাংসদ পাপুলকে রিমান্ডে নিয়েছে কুয়েতের সিআইডি। পুরো বিশ্ব যখন মানবপাচার ও মানি লন্ডারিং এর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। অভিযুক্ত দেশগুলোকে যখন কালো তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। সেই সময়ে বাংলাদেশের মত মানব সম্পদশালী একটি দেশের একজন সাংসদের এহেন আন্তর্জাতিক অপরাধ বাংলাদেশের ললাটে কলংকের তীলক এঁকে দিয়েছে। এটা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিদের দায়মুক্তির সংস্কৃতির ভয়াবহতার নজির।
২.
অথচ গত ফেব্রুয়ারিতে যখন কুয়েতের পত্রিকায় মানব পাচারকারী এই এমপির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ হয়। তখন আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে এটাকে গুজব বলে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। আর রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিরুদ্ধে বেশী কিছু বললে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে সবাই তখন মুখ বন্ধ করে রাখতে বাধ্য হয়েছিল।
কিন্তু তখন যদি সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করত। তাহলে হয়ত আজকে জাতিকে ও খোদ সরকারকে বহির্বিশ্বের সামনে এভাবে লজ্জিত হতে হতো না। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এই সীমাহীন দায়মুক্তির পরিণতি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে আজকের এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলো। ফেব্রুয়ারিতে এমপির বিরুদ্ধে খবর প্রকাশের পর তার বিরুদ্ধে লোকদেখানো একটি তদন্ত শুরু করেছিল দুদক। আর যথারীতি এই ইস্যু শেষ হয়ে যাবার পর দুদকও থেমে গিয়েছিল। তখন যদি দুদক ব্যবস্থা নেয়ার সাহস করত। তাহলে হয়ত আজকে বাংলাদেশকে মানবপাচারকারী ও মানি লন্ডারিং এর তকমা পেতে হতো না।
৩.
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবপাচার সম্পর্কিত ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় ধাপের ওয়াচলিস্টে রাখা হয়েছে। আর এদিকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্র-বিরোধী সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র। বাংলাদেশ আঞ্চলিক পর্যায়ে সার্ক ও বিমসটেকের আওতায় মানবপাচার প্রতিরোধ সহযোগিতা প্রদানকারী রাষ্ট্র। তাছাড়া মানব পাচারের বিরুদ্ধে আমাদের কঠোর আইনও রয়েছে। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এর ৭ ধারার বিধান মতে এমপি সাহেব উক্তরুপ অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর এই অপরাধে যদি তার সাজা হয় তাহলে সংবিধানের (৬৬ (২) এর (ঘ) উপধারা) মতে তার সংসদ সদস্য পদও বাতিল হবে। অথচ গত ফেব্রুয়ারিতে যদি এমপিকে আইনের আওতায় এনে বিচার করা হতো, তাহলে তিনি মানব সম্পদের বাংলাদেশকে এভাবে বহিঃবিশ্বে মানব পাচারের বাংলাদেশ বানাতে পারতেন না।
৪.
বিশ্বের ১৬৯টি দেশে বাংলাদেশের ১ কোটি ২০ লাখের মতো শ্রমিক রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যের ৬টি দেশে থাকে। এই দেশগুলোয় গত তিন মাসের বেশি সময় ধরে লকডাউন চলায় তাদের তেল-নির্ভর অর্থনীতি এক প্রকার স্থবির হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দেশে ফিরে যেতে শ্রমিকদের বাধ্য করা হচ্ছে। এই রকমের ভয়াবহ অবস্থায় আমাদের রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির এহেন মানবপাচার ও মানি লন্ডারিং কর্মকান্ড প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই দায় কি শুধুই একা এমপি সাহেবের? এটা কি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দায়মুক্তির ভয়াবহ নজির নয়?
—
ডক্টর তুহিন মালিক
আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ