স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের ১২ শতাংশ বরাদ্দ রাখার পরামর্শ
করোনার আঘাতে স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুর চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। তাই ঢেলে সাজাতে এ খাতে বাজেটের ১২ শতাংশ বরাদ্দ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
আসন্ন বাজেটের (২০২০-২০২১) রূপরেখা কেমন হওয়া উচিত- এমন প্রশ্নের জবাবে ড. সালেহউদ্দিন এসব কথা বলেন। বাজেটে কোন খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, আয় এবং ব্যয়ের মানদণ্ডই বা কী হবে- সেসব বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার এবার এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বাজেট তৈরি করছে। আগে এমনটি কখনই হয়নি। এর আগে কোনো একটি দেশে বা অঞ্চলের অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিত।
কিন্তু একসঙ্গে পুরো বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় ভয়ঙ্কর মন্দার ঢেউ, এটা নজিরবিহীন। এই অবস্থায় মন্দার কবল থেকে অর্থনীতিকে রক্ষা করার সব ধরনের দিকনির্দেশনা থাকতে হবে বাজেটে।
বাজেটের রূপরেখা হতে হবে অত্যন্ত স্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট। কী করতে চায় আর কী করতে চায় না, তা পরিষ্কার করে বলতে হবে। গতানুগতিক বাজেট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অনেক সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটের মূল ফোকাস কেমন হওয়া উচিত এ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সাবেক গভর্নর বলেন, এবারের বাজেটে বেশি ফোকাস থাকতে হবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দেশীয় শিল্প, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, উৎপাদন, কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প ও এসএমই খাতে। এছাড়া দ্রুত নজর দিতে হবে কর্মহীন, আয়হীন ও ক্ষুধার্ত মানুষের প্রতি।
যাদের খাবার ইতোমধ্যেই ফুরিয়ে গেছে। তাদের কর্ম এবং খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা করোনার থাবা গত তিন মাসে অনেক মানুষকে আয়হীন করে দিয়েছে। এদেরকে আয়ের পথে ফিরিয়ে আনতে হবে।
এজন্য প্রান্তিক মানুষের জন্য কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। এটি করতে হলে প্রথমে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হবে। সেজন্য গ্রামে টাকার প্রবাহ বাড়াতে হবে। অর্থাৎ গ্রামের যেসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুঁজি হারিয়ে বসে আছেন তাদেরকে নতুন করে পর্যাপ্ত পুঁজির জোগান দিতে হবে।
গ্রামে অনেক মাঝারি ও কুটির শিল্প রয়েছে। সেগুলোতে পুঁজির জোগান দিতে হবে। তারা পুঁজি পেলে নতুন করে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। শ্রমিকদের বেতন ভাতা দেবেন। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে।
বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও মূল শহরের বাইরে অবস্থিত। সেগুলোতেও টাকার জোগান দিতে হবে। তাদেরকেও উৎপাদন কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। এভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হলে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে শহুরে অর্থনীতিতেও। গ্রামে উৎপাদিত পণ্য শহরে আসবে। অফিস-আদালত খুলবে। এভাবে অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করবে।
অর্থনীতিতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় ঘোষিত প্রণোদনা বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রণোদনার অর্থ সহায়তা বাবদ অর্থ খরচ বা সুবিধার ব্যাপারে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে।
এ খাতে যা দেয়া হয় তার বেশির ভাগই রাজনৈতিক, দলীয় ও প্রভাবশালী লোকের পকেটে চলে যায়। যে পাওয়ার কথা সে পায় না। যার পাওয়ার কথা না, তারা পেয়ে যায়। এগুলো বন্ধ করতে হবে।
এসব বন্ধ না করলে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে কোনো লাভ নেই। প্রণোদনার টাকা যাতে শুধু প্রভাবশালীদের পকেটে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া ঘোষিত প্রণোদনা দ্রুত বাস্তবায়ন এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
এ জন্য প্রণোদনা প্যাকেজগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রণোদনা প্যাকেজগুলো সঠিক ও দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভর করবে অর্থনৈতিক সংকট হ্রাস-বৃদ্ধি।
যত দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে প্যাকেজগুলো বাস্তবায়ন হবে তত দ্রুত অর্থনীতি স্বাভাবিক হবে। এতে ঘাটতি হলে অর্থনীতির চাকা ঘুরার প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক হতে যেমন সময় লাগবে, তেমনি স্বল্প আয়ের মানুষের ভোগান্তির মাত্রাও বাড়বে। সরকারকে এ বিষয়টি ভাবতে হবে।
স্বাস্থ্য খাত সম্পর্কে তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেশের স্বাস্থ্য খাত যে কতটা দুর্বল তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। দেশে বড় বড় অভিজাত হাসপাতাল হয়েছে ঠিকই।
কিন্তু দুর্যোগে এগুলো সেবা দিতে পারে না। ফলে স্বাস্থ্য খাত এখন ঢেলে সাজাতে হবে। এই বাজেটেই এ খাতের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। এ খাতে বর্তমানে বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশে নিচে।
এবার তা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে মোট জিডিপির ৩ শতাংশ এবং বাজেটের ১০ থেকে ১২ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে হবে। অবকাঠামো তৈরির পাশাপাশি জনবল নিয়োগেও গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে গবেষণায় আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
কর্মসংস্থান বাড়ানোর প্রসঙ্গে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, ছোট ছোট, স্বল্পমেয়াদি এবং দ্রুত ফল পাওয়া যায় এমন প্রকল্পে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মানুষ দ্রুত এর সুফল পাবে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিও বাড়বে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প থেকে সরে আসতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে আরও দক্ষতা আনতে হবে। এগুলো যাতে দ্রুত মানুষের উপকারে আসে সে উদ্যোগ নিতে হবে।
একই সঙ্গে যেসব বড় শিল্প গ্রুপ রয়েছে তাদেরকে নতুন নতুন ইউনিট গড়ে তুলতে উৎসাহিত করা গেলে কর্মসংস্থান দ্রুত বাড়বে। কর্মসংস্থানের একটি বড় অংশ হচ্ছে কৃষি ও পর্যটন খাত। এ খাত দুটিকে চাঙ্গা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। যারা এখনও কর্মে আছে তাদেরও কর্মহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এরা যাতে নতুন করে কর্মহীন হয়ে না পড়ে সেজন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় রাখতে হবে। ইতোমধ্যে যারা কর্মহীন হয়ে পড়েছে তাদের জন্য তাৎক্ষণিক কর্মসৃষ্টি হয় এমন সব প্রকল্পে দ্রুত হাত দিতে হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে।
করোনার প্রভাব মোকাবেলায় শিল্প খাতে বিশেষ নজর দেয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
তাহলে শিল্পে গতি আসবে। বেকারত্ব দূর করতে হবে। এসব কর্মকাণ্ড যত দ্রুত করা যাবে ততই মঙ্গল। দেরি করার কোনো সুযোগ নেই। দেরি হলে অর্থনীতিও পিছিয়ে পড়বে। আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পিছিয়ে পড়লে মানুষকে ভুগতে হবে। সেটা কারোরই কাম্য হতে পারে না।
প্রবাসীদের প্রসঙ্গে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনার ধাক্কায় বিদেশের অর্থনীতিও খারাপ হয়ে গেছে। ফলে অনেকে কর্মহীন হয়ে দেশে চলে এসেছেন। যারা বিদেশ থেকে চলে আসছেন তাদের আর সহসা যাওয়ার উপায় নেই।
কবে নাগাদ যেতে পারবেন সেটাও নিশ্চিত নয়। ফলে রেমিটেন্সে একটা বড় ধাক্কা আসতে শুরু করেছে। এই ধাক্কাটা লম্বা হবে বলে মনে হচ্ছে। ফলে এক্ষেত্রে দুটি বিষয় ভাবতে হবে- রেমিটেন্সের ঘাটতি মোকাবেলা এবং যেসব প্রবাসী দেশে এসেছেন তাদেরকে নতুন কর্মে যুক্ত করা।
তিনি আরও বলেন, করোনার পর বিশ্ব অর্থনীতি যখন সচল হবে, তখন বিশ্বে শ্রমিকদের চাহিদা বাড়বে। সে চাহিদা মেটাতে এখনই প্রস্তুতি দরকার। তাই কারিগরি শিক্ষা বাড়াতে হবে।
এর জন্য আলাদা বরাদ্দ লাগবে। দক্ষ শ্রমিক তৈরি হলে একদিকে যেমন বিদেশে চাকরি পাওয়া যাবে, তেমনি বেশি পরিমাণে বেতন ভাতাও পাবে। এতে বাড়বে রেমিটেন্স প্রবাহ।
এ জন্য এখন বিদেশ থেকে যারা এসেছেন তাদেরকে বা বিদেশে যারা যেতে চান তাদেরকে বিশেষ ব্যবস্থায় প্রশিক্ষণ দেয়া গেলে এটি ভবিষ্যতে ভালো ফল বয়ে আনবে।
দেশের দরিদ্রদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, সামাজিক সুরক্ষা যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি এর আওতা বাড়াতে হবে। এর প্রকৃত সুবিধাভোগীদের কাছে সুফল পৌঁছে দিতে হবে।
এ খাতে যাতে কোনো ধরনের অনিয়ম না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। তা না হলে এর সুফল প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত পাবে না।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়ার কারণে অভুক্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। অসহায় মানুষের হাহাকার চারদিকে। সূক্ষ্মভাবে এর সমাধান করতে হবে। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। লোক দেখানো কিছু করা যাবে না। আর করলে এর সুফল পাওয়া যাবে না।
ব্যাংকিং খাত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনিয়ম, দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবে ব্যাংকিং খাত তলিয়ে যাচ্ছে। এ খাতকে উদ্ধার করতে দ্রুত অ্যাকশন প্ল্যান দরকার। প্রণোদনা পুরোটাই বলতে গেলে ব্যাংকনির্ভর।
অথচ ব্যাংকের সে সক্ষমতা নেই। তারা ঋণ দিতে চাচ্ছে না আদায় না হওয়ার ভয়ে। এ খাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে একটা সমন্বয় থাকা দরকার।
বাজেট ঘাটতি সম্পর্কে তিনি বলেন, বাজেট ঘাটতির অর্থ বাইরে থেকে আনা দরকার। দেশের ভেতর থেকে এত বিপুল পরিমাণ অর্থসংস্থান করতে গেলে বেসরকারি খাতে ঋণের গতি কমে যাবে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিদেশি সংস্থাগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে অর্থ সহায়তার বরাদ্দ বাড়াতে হবে।