লাল সতর্কতা কারফিউ’র পরামর্শ
দেশে করোনা সংক্রমণের বিস্তারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন। মহামারি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আরো কঠোর লকডাউনের কথা বলছেন তারা। অধিক সংক্রমিত এলাকায় কারফিউ দেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন। সরকার আক্রান্ত এলাকাগুলো লাল, হলুদ এবং সবুজ জোনে চিহ্নিত করে সংক্রমণ প্রতিরোধ করার কথা ভাবছে। বর্তমান অবস্থায় হাসপাতালগুলোতে রোগীর ঠাঁই হচ্ছে না। অক্সিজেনের অভাবে ছটফফট করছেন রোগী। আইসিইউ’র ক্রাইসিস চরমে। পাওয়া যায় না সাধারণ সিটও।
ইতিমধ্যে শনাক্তের সংখ্যা ষাট হাজার অতিক্রম করেছে। মারা গেছেন আটশ’র ওপরে।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এবং মৃতুহার কমতে শুরু করায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান সংক্রমণের মধ্যেই সবধরনের গণপরিবহন এবং অফিস ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কলকারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতি সচল করার স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নিলেও এতে সংক্রমণ এবং আক্রান্তের সংখ্যা আরো বাড়বে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর তৈরি হবে বাড়তি চাপ।
দিন যতই গড়াচ্ছে দেশে করোনার ভয়াল থাবা ততোই ছড়িয়ে পড়ছে। বাড়ছে করোনা শনাক্ত রোগী। অধিকাংশই বাসায় চিকিৎসা নিলেও যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। রোগীর সংখ্যা বাড়ায় হাসপাতালে করোনার রোগীরা সিট পাচ্ছে না। যদিও করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত যে হাসপাতালগুলো আছে সেই হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নেই অবস্থা। অক্সিজেনের চরম সংকট। রোগীরা অক্সিজেনের জন্য কাঁদছেন। একটু অক্সিজেনের জন্য রীতিমতো গড়াগড়ি খাচ্ছেন। এখনই করোনার রোগীর হাসপাতালে সাধারণ শয্যা না পাওয়ার অভিযোগ করছে অহরহ। অনেকে চিকিৎসা না পাওয়ার আগেই উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। করোনার পরীক্ষা করাতে তিন চার দিনও অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কিট সংকট রয়েছে চরমে। ফলে ভোগান্তিতে পড়ছে মানুষ। রাজধানীসহ সারাদেশে নমুনা পরীক্ষার জন্য যেসব হাসপাতাল রয়েছে সেগুলোতে রয়েছে কিট সংকট এবং চরম অব্যবস্থাপনা। নমুনার ফলাফল পেতেও লেগে যায় কয়েকদিন। করোনা টেস্ট ব্যাপকভাবে না হওয়ার কারণে আক্রান্ত অনেকেই জানতে পারছে না যে তার করোনার সংক্রমণ রয়েছে। অথচ ওই ব্যক্তি নিজের অজান্তে বাসা থেকে শুরু করে বাজার, অফিস আদালত সবদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ভাইরাস অন্যদের মধ্যে ছড়াচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, এখন সংক্রমণ আরো বেড়ে যাবে। যে অবস্থা তাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। বাংলাদেশের একটা জেনারেল কন্ডিশন হলো, ভাইরাসটা আগে আগে যাচ্ছে বাংলাদেশে পিছে পিছে। এতে আমাদের ভুগতে হবে। অনেক মানুষ সংক্রমিত হয়ে যাবে। মানুষ সংক্রমিত হয়ে গেলে তাদের হাসপাতালের বেড বাড়াতে হবে, সুবিধা বাড়াতে হবে। সেদিক থেকেও আমরা খুব বেশি অগ্রগতি সাধিত করতে পারিনি।
করোনার পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে কঠোর লকডাউন দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ। তিনি এই পরামর্শের কথা জানিয়ে বলেন, আরো ৭ থেকে ১০ দিন দেখতে হবে। করোনার পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। এখন প্রতিদিনই সংক্রমণের হার বাড়ছেই। মৃত্যুও হচ্ছে অনেক। বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সরকারের সামনে দুটি প্রশ্ন। একদিকে জীবন অন্যদিকে জীবিকা। জীবনও বাঁচাতে হবে। জীবিকা নিয়েও ভাবতে হবে। দুটির মধ্যেই ভারসাম্য জরুরি। তিনি বলেন, প্রশাসনের দুর্বলতা আর জনগণের শৈথিল্যতা সবমিলিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে দেশ। আগে গ্রামের অবস্থা ভালো ছিল। এখন ধীরে ধীরে গ্রামের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ঢাকার বাইরে আগের চেয়ে রোগী বেড়েছে। ঈদে লাখ লাখ মানুষ গ্রামে গিয়ে এ রোগের বিস্তার ঘটিয়েছে। আবার এই মানুষগুলো ঢাকায় এসে নতুন করে তা ছড়াচ্ছে। এতে আমাদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়েছে বহুগুণ। তিনি আরো বলেন, দুই মাস মানুষ ঘরে থাকায় তাদের একটু অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে। লকডাউনও মানেনি অনেকে। এখন পরিস্থিতি ভয়াবহ হলে কঠোর লকডাউন ছাড়া কোন উপায় নেই। আর তা পালনে মানুষকে বাধ্য করতে হবে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এখন মহামারী পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এটা মানুষকে বুঝতে হবে। তাই মানুষকে সামাজিক দূরত্ব বজায় বাখতে হবে।
সরকারের কোভিড-১৯ নিয়ে গঠিত ট্রিটমেন্ট সাব-কমিটির সদস্য ও ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ রিসার্স সেন্টারের প্রধান অধ্যাপক ডা. রিদওয়ান উর রহমান বলেন, আমাদের ব্যবস্থাপনার বড় দুর্বলতা রয়ে গেছে। এখানে কে যে কোথায় কি করছেন আমরা তাই বলতে পারছি না। আমাদের এখানে প্রথম থেকেই কোন কিছুই সঠিক পরিকল্পনা মাফিক হয়নি। আমরা শর্ত পূরণ না করেই লকডাউন তুলে দিয়েছি। এখন আক্রান্তের হার যেভাবে বাড়ছে সেই নম্বর কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা-ও প্রেডিকশন করা যাচ্ছে না। আগামী দশ দিনে আক্রান্তের হার বাড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। আমরা তো রোগ নির্ণয় করতেই পরছিনা। আমাদের এখানে টেস্ট বাড়ছে, রোগীও বাড়ছে। টেস্ট যদি এক লাখ হতো তাহলে রোগীও এর দশগুণ হতো। দেশব্যাপী করলে পুরোদেশের চিত্র পাওয়া যেত। আমাদের সীমিত সংখ্যক জায়গায় টেস্ট হচ্ছে। এই সীমিত সংখ্যক স্থানে যারা কষ্ট করে টেস্ট করাতে পারছেন সেই ডাটাটাই আমরা পাচ্ছি। বর্তমান হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ১২,০০০ টেস্টের মধ্যে প্রায় তিন হাজার রোগী কোভিড শনাক্ত হচ্ছে। অর্থাৎ সংখ্যাটা প্রায় পঁচিশ ভাগ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র মতে, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য এখন পর্যন্ত ১১২টি হাসপাতালে বেড রয়েছে ১৩ হাজার ৯শ ৮৪টি। আর সারা দেশের কোভিড রোগীদের জন্য বরাদ্দ আছে আইসিইউ শয্যা ৩৯৯টি। ৩০০টি ভেন্টিলেটর আর ১১২টি ডায়ালাইসিস ইউনিট। সমপ্রতি ৫০ শয্যার হাসপাতালগুলোতে সব ধরণের রোগীদের চিকিৎসার নির্দেশ দেয়ায় আরও ৩শ’ হাসপাতাল যোগ হবে।