বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে মরণঘাতি স্রোত: দি ইকোনমিস্টের খবর

0

গত সপ্তাহ জুড়ে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান অনেকাংশেই লকডাউন তুলে নিয়েছে। কিন্তু দেশব্যাপী লকডাউন তারা দিয়েছিল কোভিড -১৯ এর বিস্তার রোধ করার লক্ষ্যেই। ১৭০ কোটি মানুষ, যারা বিশ্বের জনগোষ্ঠীর এক চতুর্থাংশের বেশি, তারা বিভিন্ন বিধিনিষেধের আওতায় ছিল, এখন লকডাউন প্রত্যাহার অঞ্চলটির ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে একটি মুক্তি দেবে।

কিন্তু দু:খের কথা হলো এই পদক্ষেপ তাদেরকে অতিমারী থেকে কোনও নিস্তার দেবে না। ভাগ্যবান দেশগুলিই কেবল, বাড়িতে থাকার নিয়মগুলি প্রতিপালনের মধ্য দিয়ে তারা আক্রান্তের সংখ্যা কমাতে পেরেছে।

দক্ষিণ এশিয়া কেবলমাত্র রোগের সংক্রমণকে একটা মাঝারি অবস্থায় রাখতে পেরছে। তারা থামাতে পরেনি। লকডাউন তুলে নেওয়ার ফলে আবার ভাইরাসের দ্রুত বিস্তার ঘটাতে পারে।

এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন লাখ রোগী পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যা ইতিমধ্যে ৯ হাজারের চেয়ে সামান্য কম। অবশ্য মৃতের সংখ্যা বিচারে অঞ্চলটিকে মডারেট বা মাঝারিই বলা চলে।
তবে তুলনামূলকভাবে এই পরিমিত চিত্রটা যথাযথ নয়। এটা ছদ্মবেশী। কারণ আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাদের সংক্রমণ বৃদ্ধির হার কোনোটিরই প্রকৃত ছাপ ওই পরিসংখ্যানে নেই। লকডাউন তুলে নেওয়ার আগেই আক্রান্তের সংখ্যা ভীতিজনক পর্যায়ে পৌছেছিল। বর্তমানে যে গতিতে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে। এটা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, জুলাইয়ের শেষের দিকটি, যখন কিছু মডেলের প্রাদুর্ভাব পূর্বাভাস অনুযায়ী, পিকে বা উচুতে থাকার কথা, তখন আক্রান্তের সরকারি পরিসংখ্যান ৫০ লাখ এবং মৃতের সংখ্যা দেড় লাখে পৌছাতে পারে।

বাংলাদেশের ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, (আইসিডিডিআরবি) এর প্রাক্কলন অনুযায়ী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতেই আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যে সাড়ে ৭ লাখে উন্নীত হয়েছে। যদিও সরকারি হিসেবে আক্রান্তের সংখ্যা ৬০ হাজারের নিচে।

দক্ষিণ এশিয়ার বেশি অনগ্রসর অঞ্চলগুলাতে স্বাস্থ্যসেবা গুরুতর চাপের মধ্যে রয়েছে। মুম্বাইয়ের শহরতলির থানায় ৪৬ বছর বয়সী নার্স মাধুরী (প্রকৃত নাম নয়) । এপ্রিল থেকে কোনও দিনই তিনি ডেঅফ নিতে পারেননি। ১২ ঘন্টার শিফটে প্রতিদিন কাজ করছিলেন। অবশ্য তিনি রেহাই পান যখন গত মে মাসে তিনি একজন রোগীর কাছ থেকে কোভিড -১৯ এ সংক্রমিত হন। তিনি যে সরকারী হাসপাতালে কাজ করেন সেখানে করোনা রোগের চিকিত্সা হয় না। কোভিডের জন্য মনোনীত হাসপাতালগুলোতে তারা রোগীদের পাঠিয়ে দেন। তবে মাধুরী (তার আসল নাম নয়) বলেছেন যে, তার সহকর্মীদের অবশ্যই উচিত হবে এভাবে না পাঠিয়ে দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া।

“এখন আমরা দিনে ৬০ থেকে ৭০ জন রোগীর চিকিৎসা দেই। সাধারন সময়ে এটা ছিল ৪০ থেকে ৫০ জন। এর বাইরে রয়েছে ছুরিকাঘাতের আঘাত, দুর্ঘটনা ইত্যাদির শিকার হয়ে যারা আসেন তাদের সেবা দেওয়া। তার হাসপাতালে ২০ শয্যাবিশিষ্ট নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট আছে। কিন্তু মাত্র দু’জন নার্স । এবং তাদের ১৬ শয্যাবিশিষ্ট আইসোলেশন ওয়ার্ডে নার্স আছেন মাত্র একজন।

তার অভিজ্ঞতা স্বাভাবিকতার থেকে অনেক দূরে। মুম্বাইয়ের কেন্দ্রে অবস্থিত অপর একটি হাসপাতালের তিন জন মেডিকেল ইন্টার্ন সম্প্রতি একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন। যাতে দাবি করা হয়েছে যে, তারা গুরুতর অসুস্থ ৩৫ জন কোভিড–১৯ রোগীর দেখভালের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে দায়িত্বে রয়েছেন। সেখানে কোনও চিকিত্সক নেই। এমনকি তাদের সহায়তার জন্য কোনো নার্স বা ক্লিন করার স্টাফও ছিল না। ভাইরাল হওয়া অন্য একটি ভিডিওতে দেখা গেছে যে, হাসপাতালের মর্গে জায়গা না থাকায় প্লাস্টিকের মোড়কে মোড়ানো লাশ রোগীতে পূর্ণ কোভিড ওয়ার্ডে রেখে গেছে। ভারতজুড়ে হাসপাতালের স্টাফরা কর্মক্ষেত্রের অনিরাপদ পরিস্থিতি, দুর্বল সরঞ্জাম এবং দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য হওয়ার বিরুদ্ধে বারংবার প্রতিবাদ করছে।

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে প্রায় ৬ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী কোভিড -১৯-এ পজিটিভ হয়েছেন। যার মধ্যে দেশের সবরবৃহৎ সরকারী হাসপাতাল অল-ইন্ডিয়া মেডিকেল সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটেরই ৩২৯ জন রয়েছেন। সামগ্রিকভাবে, ভারতের জনসংখ্যার তুলনায় চিকিত্সক ও নার্সের অনুপাত যা রয়েছে, সেটা চীনের অর্ধেক এবং ইউরোপের তুলনায় এক চতুর্থাংশ। আর ভাইরাসটি এখন চিকিৎসা সমৃদ্ধ শহরগুলো থেকে ঝাড়খন্ডের মতো গ্রামীন দরিদ্র রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য একজন করে ডাক্তার রয়েছে।

পাকিস্তানের চিকিত্সকরা বলেছেন যে, দেশটির সরকার পর্যাপ্ত হাসপাতালের শয্যা রয়েছে বলে যে দাবি করছে তা বাজে কথা। পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের কায়সার সাজ্জাদ বলেছেন, “পরিস্থিতি অত্যন্ত, অত্যন্ত অসন্তুষ্টিজনক। তিনি রমজানের শেষ দিকের সাম্প্রতিক ছুটিকালকে ব্যাপক বিস্তারের একটি উৎস বলেও উল্লেখ করেন। খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের স্থানীয় চিকিত্সক সমিতির প্রধান জুবায়ের জহির। তিনি আশঙ্কা করছেন যে, তাদের হাসপাতালগুলোতে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আর কোনো রোগীকে নিবিড় পরিচর্যা শয্যা ও ভেন্টিলেটর সুবিধা দিতে পারবে না। এই সঙ্কট ইতিমধ্যে অন্যান্য পরিষেবাগুলিকেও সঙ্কুচিত করেছে। পোলিও–র পুনরুত্থান ঘটা সত্ত্বেও, প্রদেশটিতে একটি টিকাদান অভিযান স্থগিত করা হয়েছে। ভারতে যক্ষ্মার মতো রোগের চিকিত্সাসমূহ বাধাগ্রহস্ত হয়ে পড়েছে। যক্ষ্মায় বছরে প্রায় চার লাখ মানুষ প্রাণ হারায়।

সাধারণ সময়ে, দক্ষিণ এশিয় ধনী ব্যক্তিরা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি উদাসীন থাকতে পারেন। দশকের পর দশক ধরে স্বাস্থ্যখাতের সরকারি ব্যয় অত্যল্প থাকার কারণে এই ব্যবস্তার ভঙ্গুরত্ব তাদের স্পর্শ করে না। ঢাকায় একটি বেসরকারী হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেছেন, “তাদের যদি এতোটুকু হাঁচি আসে, তবে তারা থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা ভারতে চলে যান। এখন, তিনি ( একজন নারী চিকিৎসক) বলেছেন, কোভিড -১৯ বা অন্যান্য অসুস্থতা যাই হোক, বাংলাদেশের অভিজাত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া “প্রায় অসম্ভব”। এমনকি মর্গ, কবরস্থান বা শ্মশানঘাটেও কোনো জায়গার সন্ধান পাওয়া একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে।

মুম্বাইয়ের বাইরে থানের সবচেয়ে বড় শ্মশানঘাট জওহর বাগ। দাহ করার সংখ্যা লাফিয়ে বাড়তে দেখা গেছে। এখানে লোকবল বাড়ানো হয়েছে। আগে ছিলেন ৩০ জন। এটা ৫০ জনে উন্নীত করা হয়েছে। প্রতিদিন চার থেকে ছয় দিন, আবার কখনও ২০ জনের শেষকৃত্য চলে। প্রতিদিন তিন শিফটে কাজ চলে। দিল্লি কাঠের তৈরি চিতায় দেহভস্মের বিধানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে। দূষণ কমাতে এটা করা হয়েছিল। কিন্তু এখন দাহ করার চাহিদা বেড়েছে। আবার গ্যাসচালিত ওভেনেরও বড় অভাব রয়েছে।

অনিবার্যভাবে, তিনটি দেশই মহামারী নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে আত্মসন্ধান এবং দোষারোপ করার নীতিকে চাঙ্গা করেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জোরেশোরে বলছেন, তিনি কখনই লকডাউনের অনুরাগী ছিলেন না। যে বিষয়ে তিনি সতর্ক করেছিলেন যে, লকডাউন দরিদ্রদের অকারণে বেশি আঘাত করতে পারে এবং তা রোগটিকে কেবলই ধীর করতে পারে। অবশ্য তার সমালোচকরা একথার পিঠে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, ইমরান সরকারের ব্যর্থতার একটি বড় কারণ হ’ল পাকিস্তানের লকডাউন গোড়া থেকেই অকার্যকর করা ছিল। কারণ তা আধাখেচড়া এবং অদক্ষ উপায়ে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছিল। বাংলাদেশে কোভিড মোকাবেলায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন তৈরি, বস্তিগুলোতে আনুমানিক ৭৫ ভাগ গড় আয়ের পতন এবং কয়েক হাজার পোশাক শ্রমিকের গ্রামে ফিরে যাওয়ার মতো ঘটনা লকডাউন থেকে লাভের সম্ভাবনাকে হ্রাস করে।

সম্ভবত সবচেয়ে গুরুতর গলদপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভারত। এই অঞ্চলে সর্বাধিক কঠোর এবং কঠোরভাবে পালিত নিষেধাজ্ঞাগুলো ভারত সরকার ঠিকই চাপিয়ে দিতে পেরেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সরকার এটা অনুমান করতে ব্যর্থ হয়েছিল যে তাদের এই পদক্ষেপগুলো লাখ লাখ আন্তরাজ্য অভিবাসী শ্রমিকদের ফাদে ফেলে দেবে। তারা তাদের নিজ রাজ্যের বাইরের শহরগুলিতে হঠাৎ করেই নিঃস্ব হয়ে যাওয়া এক বিশাল জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ সর্বপ্রথম তাদের ঘরে ফেরার আন্দোলনটি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এরফলে শহুরে বস্তিগুলিতে সর্বাধিক সংক্রমণের হারের শংকা নিয়ে অভিবাসী শ্রমিকরা ঠাই নিয়েছিল। এরপর তারা সম্ভবত এরকম ২০ লাখ শ্রমিককে নিজ নিজ রাজ্যে ফেরার অনুমতি দেয়। এভাবেই তারা রোগটিকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়। বিহার, এমন একটি রাজ্য, যার ১ কোটি ১০ লাখ দরিদ্র মানুষ আছে। রাজ্যটি সববথেকে দরিদ্রদের অন্যতম। সেখানে এখন পর্যন্ত চিহ্নিত হওয়া কোভিড রোগীর দুই তৃতীয়াংশেরও বেশির সংক্রমণ চিহ্নিত হয়েছে প্রত্যাগত শ্রমিকদের মধ্য থেকেই।

কারণ যাই হোক না কেন, ক্ষতি যা হবার হয়েছে। বাংলাদেশের বন্দর নগরী চট্টগ্রামের একজন কবরখাননকারী ফরিদ উদ্দিন। কথা বলতে গিয়ে তিনি প্রায় চোখের জল ফেলেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, তিনি এবং তাঁর দল গত চারদিনের মধ্যে খুব কম সময়ই ঘুমিয়েছেন।

“অনেক মৃত্যু। আমরা ভারাক্রান্ত। আমাদের জন্য দোয়া করুন, আল্লাহ যাতে আমাদের ক্ষমা করেন। এবং এই রোগটি ফিরিয়ে নেন। ”

(দি ইকনোমিস্টের এশিয় মুদ্রণ সংস্করণে ‘‘মরণঘাতি স্রোত’’ শিরোনামে এই নিবন্ধটি ছাপা হয়)

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com