আরেক দফা কঠোর লকডাউন দেয়ার আহ্বান
করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় সুন্দর অর্থনীতির স্বার্থে আরেক দফা কঠোর লকডাউন দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। ‘রিসারজেন্ট বাংলাদেশ’ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তারা এ আহ্বান জানান।
‘রিসারজেন্ট বাংলাদেশ’ কোভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে কৌশল ও নীতি-সহায়তা প্রণয়নের স্বার্থে গঠিত একটি প্ল্যাটফর্ম। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই), ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই), বিল্ড এবং পলিসি এক্সচেঞ্জের যৌথ উদ্যোগে এই প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠিত।
লকডাউন প্রস্থান কৌশল কাঠামো উপস্থাপনের অংশ হিসেবে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এ আলোচনার আয়োজন করে ‘রিসারজেন্ট বাংলাদেশ’। আলোচনায় এমসিসিআই সভাপতি নিহাদ কবির সূচনা বক্তব্য রাখেন।
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ লকডাউন থেকে কীভাবে বের হয়ে আসা যায় তার ওপর প্রস্তাবিত কৌশল কাঠামো এবং রিসারজেন্ট বাংলাদেশের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
আলোচনায় বক্তব্য রাখেন পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর, শ্রীলংকায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহ, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্যসচিব আব্দুল করিম, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সিপিডির সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এনএইচএস ট্রাস্টের ডা. শাকিল ফরহাদ, বেসিসের সাবেক সভাপতি হাবিবুল্লাহ এন করিম, সাবেক আইন সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক, ডেলয়েটের নির্বাহী উপদেষ্টা শরিফ ইসলাম, বিল্ডারের চেয়ারম্যান আবুল কাসেম খান, ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশেদুল ইসলাম, অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসাদ ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক রাশেদুর রহমান প্রমুখ।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহীম মুক্ত আলোচনা সঞ্চালনা করেন।
এমসিসিআই সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, প্রবৃদ্ধি কী হবে, না হবে এটা নিয়ে এখন ভাবার সময় নয়। এখন মূল ভাবনার বিষয় হচ্ছে বৃহত্তর অর্থনীতির স্বার্থে কীভাবে লকডাউন পরিস্থিতি থেকে সর্বোচ্চ জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে বের হয়ে আসা যায়। যদি করোনা পরিস্থিতি খুব একটা স্থিতিশীলতার দিকে সহসাই না যায় তবে অল্প কিছুদিনের জন্য পুনরায় কঠোর লকডাউন দেয়া যেতে পারে। যাতে সামগ্রিক অর্থনীতি সামনে একটি সুদিন দেখতে পায়। চাহিদা ও জোগানের সাপ্লাই চেইন যদি স্বাভাবিক হয়ে আসে তবে অর্থনীতি আবারও তার গতি ফিরে পাবে।
পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, যদি মহামারি যেতে আরও দেরি হয়, তাহলে ভবিষ্যতের সুন্দর অর্থনীতির স্বার্থে হলেও কিছুদিনের জন্য একটি কঠোর লকডাউন প্রদান করা যেতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে কিছুদিনের লকডাউন অর্থনীতির সামান্য ক্ষতি করলেও পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটলে এর সুফলও পাওয়া যাবে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বেসরকারি খাতকে সরকারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে যেতে পরামর্শ দেন, যাতে করে একটি সমন্বিত লকডাউন প্রস্থান পদ্ধতি পরিকল্পনা করা যায়।
সিপিডির সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশ একটি ক্রান্তিলগ্ন অতিক্রম করছে। নীতিমালা সংশোধন প্রক্রিয়ায় কোনো ত্রুটি থাকা যাবে না। আর্থ-সামাজিক খাতে যাতে কোনোরকম অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এ বছর ৩ শতাংশ কমে যেতে পারে। বৈশ্বিক বাণিজ্যও ১৩-৩০ শতাংশ কমে আসতে পারে। এশিয়ার রফতানি ৩৬ শতাংশ কমে আসতে পারে এবং সারাবিশ্বে প্রায় ১৯৫ মিলিয়ন কর্মজীবী তাদের চাকরি হারাতে পারেন। কিন্তু প্রকৃত ক্ষতি নিরূপণে ও করোনার প্রভাব যাচাই করতে আমাদের সঠিক, নির্ভরযোগ্য ও নির্ভুল তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন।
সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর মধ্যে সুষম সমন্বয় প্রয়োজন বলে অভিমত দেন শ্রীলঙ্কায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহ। একই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তাও উল্লেখ করেন তিনি। রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহ এ মহামারি থেকে উত্তোরণে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির পরামর্শ দেন।
সাবেক আইন সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হকও সরকার ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, একটি সমন্বিত লকডাউন এক্সিট কৌশল প্রণয়নে যথাযথ তথ্য-উপাত্ত অত্যধিক প্রয়োজন। সরকারের প্রচুর আইন রয়েছে। তবে আইন থাকার চেয়ে এর যথাযথ কঠোর প্রয়োগ অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আব্দুল করিম বলেন, লকডাউন থেকে প্রস্থানের কৌশল নির্ধারণ এ মুহূর্তে জীবন ও জীবিকার জন্য প্রয়োজন। এমন একটি পরিকল্পনা প্রণয়নে আমরা তথ্যপ্রযুক্তি, বিগ ডাটা ইন্টেলিজেন্স ও ব্যাক চেইনের সাহায্য নিতে পারি।
তিনি আরও বলেন, সরকারি-বেসরকারি সমন্বয় ছাড়া এ ধরনের একটি কৌশল কাঠামো নির্ধারণ করা যাবে না। কৃষির ওপর এ সময় অধিক গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিল্ডের চেয়ারম্যান আবুল কাসেম খান বলেন, করোনা পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি, যদিও কিছু কিছু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত পরিসরে চলছে। লকডাউন-পরবর্তী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় কৌশল নির্ধারণে আইন ও নীতিমালার কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন। সেজন্য আমাদের দরকার সঠিক, নির্ভরযোগ্য, তথ্য-উপাত্তভিত্তিক নির্ভুল ডাটা যাতে করোনার প্রকৃত প্রভাব পর্যালোচনা করা যায়। কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যতীত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকেও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রাখতে হবে।
ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাসমূহের সুরক্ষার ওপর জোরারোপ করেন। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এখন একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ মন্তব্য করেন তিনি। পাশাপাশি তিনি এ মহামারি থেকে উত্তোরণের জন্য স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয় ও সরকারের বিধিসমূহের কঠোর বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করেন।
ডেলয়েটের নির্বাহী উপদেষ্টা শরিফ ইসলাম বলেন, সরকারপ্রদত্ত প্রণোদনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে তারল্য সংকট দেখা দেবে না। তবে প্রণোদনার সঠিক বিতরণের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
অক্সফোর্ডের ম্যানর হাসপাতালের উপদেষ্টা শাকিল ফরিদ বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকার কিছুদিনের জন্য কঠোর লকডাউনে যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে জোনভিত্তিক কৌশল কাজে আসতে পারে। তিনি বাংলাদেশের স্বার্থে, বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য একটি লকডাউন প্রস্থান কৌশল প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক রাশেদুর রহমান বলেন, যেহেতু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ তাই এগুলো সংগ্রহে যুব সমাজকে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কাজে লাগানো যেতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসাদ ইসলাম আক্রান্ত রোগী খুঁজতে বেশি বেশি কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, প্রণোদনার সঠিক বিতরণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে।