করোনা ঠেকাতে ‘রেড জোনে’ কারফিউ দেয়ার পরামর্শ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার কমতে শুরু করায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে আর বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান সংক্রমণের মধ্যেই সবধরনের গণপরিবহন এবং অফিস ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কলকারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন অর্থনীত সচল করার স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নিলেও এতে সংক্রমণ এবং আক্রান্তের সংখ্যা আরো বাড়বে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর তৈরি হবে বাড়তি চাপ।
সরকার এখন পরিকল্পনা করছে সারাদেশের আক্রান্ত এলাকাগুলো লাল, হলুদ এবং সবুজ জোনে চিহ্নিত করে সংক্রমণ প্রতিরোধ করবে। তবে মহামারী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরো কঠোর লকডাউন এবং অধিক সংক্রমিত এলাকায় কারফিউ দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
অর্থনীতি, জীবন-জীবিকা সচল করার স্বার্থে সরকার গত সপ্তাহ থেকে পরীক্ষামূলক ভাবে সবকিছু চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্ত দেয়া হয়। আর বাইরে বের হলে সবাইকে মাস্ক পরাও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বাস্তবতায় গণপরিবহন, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবক্ষেত্রে নিরাপদ দূরত্ব কিংবা স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মানা সম্ভব হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কি চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে পারবে?
এই প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এবং ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলছেন, এখন সংক্রমণ আরো বেড়ে যাবে।
‘যে অবস্থা তাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। বাংলাদেশের একটা জেনারেল কন্ডিশন হলো, ভাইরাসটা আগে আগে যাচ্ছে বাংলাদেশে পিছে পিছে।’
‘এতে আমাদের ভুগতে হবে। অনেক মানুষ সংক্রমিত হয়ে যাবে। মানুষ সংক্রমিত হয়ে গেলে তাদের হাসপাতালের বেড বাড়াতে হবে, সুবিধা বাড়াতে হবে। সেদিক থেকেও আমরা খুব বেশি অগ্রগতি সাধিত করতে পারি নাই,’ বলেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য এখন পর্যন্ত ১১২টি হাসপাতালে বেড রয়েছে ১৩ হাজার ৯শ ৮৪টি। আর সারাদেশের কোভিড রোগীদের জন্য বরাদ্দ আছে সবমিলিয়ে ৪০০টি আইসিইউ বেড, ৩০০টি ভেন্টিলেটর আর ১১২টি ডায়ালাইসিস ইউনিট।
অর্থনীতি, জীবন-জীবিকা সচল করার স্বার্থে সরকার গত সপ্তাহ থেকে পরীক্ষামূলক ভাবে সবকিছু চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্ণধার এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, যখন আরো কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন তখন সবকিছু খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত মহামারী পরিস্থিতি আরো জটিল করবে।
‘এর মধ্যেই করোনা চিকিৎসা করতে গিয়ে বাংলাদেশ একটি নাজুক অবস্থায় পড়ে গিয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি ঢাকাতে একটি আইসিইউ বেড পাওয়ার জন্য করোনা রোগীর আত্মীয় স্বজনেরা পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে, কিন্তু পাচ্ছে না।’
‘এমন অনেক অভিযোগ গণমাধ্যমে এসেছে যে রোগী আইসিইউ বেড না পেয়েই মারা যাচ্ছে। তার মানে হচ্ছে যে, যখন এই সংক্রমণ বেড়ে যাবে। আমাদের এই নাজুক স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাটি এই চ্যালেঞ্জটা বহন করতে পারবে কিনা এটি নিয়ে আমি প্রবলভাবে সন্দিহান।’
কতটা কার্যকর হবে লাল, হলুদ, সবুজ জোনে ভাগ করা?
অঘোষিত লকডাউন তুলে দেয়ার পর উদ্বেগের মূল কারণ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর বৃদ্ধির পরিসংখ্যান। দেশে প্রথম সংক্রমণ শুরুর পর ৫৭ দিনের মাথায় ১০ হাজার রোগী পাওয়া যায় আর শেষ চারদিনেই আক্রান্ত ১০ হাজারের বেশি। এছাড়া শুরুর পর প্রতি সপ্তাহেই আক্রান্ত বৃদ্ধির যে প্রবণতা সেটি এখনো চলমান।
বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত শনাক্তের পর ১৩তম সপ্তাহে আক্রান্তে সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৫৪৩ জন। জুনের প্রথম চারদিনই দুই হাজারের ওপরে মানুষ আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে। মোট আক্রান্ত ৫৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আর কোভিড-১৯ উপসর্গ নিয়েও দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট আইইডিসিআর জানাচ্ছে সবকিছু খুলে দেয়ার ফলে সংক্রমণ বাড়বে এবং জুনের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ কমতে শুরু করতে পারে।
ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সারাদেশের আক্রান্ত এলাকায় লাল, হলুদ ও সবুজ অঞ্চলে ভাগ করার যে পরিকল্পনা জানানো হয়েছে সেখানে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানার সুপারিশ করা হচ্ছে।
আইইডিসিআর এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘ঢাকা এবং সারাদেশের জেলা উপজেলা পর্যায়ে এটা করতে হবে। আমরা এলাকা অনুযায়ী ছোট ছোট জায়গায় সম্পূর্ণ লকডাউন, সেটা বাড়ি থেকে বের হওয়া, দোকান-পাট অফিস আদালত সবকিছু বন্ধ রেখেই এ কাজটা করতে চাচ্ছি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, ‘রেড, গ্রীন এবং ইয়োলো জোনের ব্যাপারটা আমরা খুব সতর্কতার সাথে চিন্তা করছি। আমরা কিন্তু জানি ঢাকা কিন্তু রেড জোনের মধ্যে।’
‘আমরা যদি হিসাব করি তাহলে ৫৪ শতাংশ কেইস ঢাকা মহানগরীর মধ্যে আর ঢাকা জেলার মধ্যেই দেশের সবচে বেশি কেইস।’
এদিকে অঘোষিত লকডাউন তুলে দেয়ার পর পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে কিছু এলাকায় কারফিউ দিতে হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ‘সাধারণ ছুটির কথা যখন বলেছিল তখন কিন্তু লকডাউনের কথাই বলেছিল। শুধু ‘লকডাউন’ উচ্চারণ করেনি। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।’
‘সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, হয়তো কোনো কোনো জায়গায় কারফিউ দিতে হবে। পরিস্থিতি অলরেডি এমন হয়ে গেছে, রেডজোনে কারফিউ দেয়া ছাড়া আর কী করবে?’
তবে বাংলাদেশে যেখানে সরকারিভাবে লকডাউন শব্দটিই ব্যবহার করা হয়নি, সেখানে কারফিউ দেয়া হবে কিনা সেটি নিয়ে সংশয় রয়েছে।
আইইডিসিআর’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন কারফিউ না দিয়েও পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায়। যেমন শুরুর দিকে কঠোর লকডাউন দিয়ে সফলতার নজির রয়েছে শিবচরে। তবে তিনি স্বীকার করেন সংক্রমণের হটস্পট ঢাকায় লাল, হলুদ সবুজ এলাকা ঘোষণা এবং তার বাস্তবায়ন জটিল।
‘ঢাকায় খুবই মুশকিল। আমরা যারা ঢাকায় বসবাস করি তারা হয়তো মতিঝিল অফিস করি, উত্তরায় থাকি। এখন উত্তরা যদি গ্রিন জোন হয় আপনি রেড জোনে এসে আপনি অফিস করতে পারবেন কিনা – এগুলো একটু জটিল সিদ্ধান্ত।’
আলমগীর বলছেন, ‘এখানে চ্যালেঞ্জও আছে। রেড জোনে আমি যদি শক্তভাবে পালন না করতে পারি সব নিয়মকানুন তাহলে দেখা যাবে যে গ্রিন জোনে যাওয়ার জন্য মানুষ আকুল হয়ে থাকবে। আবার ছুটতে শুরু করবে। এগুলি মাথায় রাখতে হচ্ছে, এগুলোতো চ্যালেঞ্জ বটেই।’
ঈদ যাত্রায় বিধিনিষেধ না থাকার ফলে ইতোমধ্যে একদিনে ৩ হাজারের কাছাকাছি রোগী শনাক্ত হতে দেখা গেছে। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও প্রতি মিলিয়নে সবচেয়ে কম পরীক্ষা করছে বাংলাদেশ। তাই আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলেই আশঙ্কা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবধরনের গণপরিবহন চালু এবং অফিস আদালত, দোকানপাট খুলে দেয়ার কারণে সংক্রমণ কতটা বৃদ্ধি পায় সেটি বোঝা যাবে আগামী ৭ থেকে ১০দিনের মধ্যেই।
সূত্র : বিবিসি