রাহুর দশা কাটছে না বিমানের

0

নানা উদ্যোগ নিয়েও রাহুর দশা থেকে মুক্তি মেলেনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে আরও বেকায়দায় পড়ে দেশের একমাত্র জাতীয় পতাকাবাহী এই বিমান সংস্থাটি। সম্প্রতি কয়েকটি বোয়িং উড়োজাহাজ আনা হলেও কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে বেগ পোহাতে হচ্ছে। এমনকি নিয়মিত বেতনাদি দিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। ডেপুটেশনে আসা কর্মী ছাড়া সবার বেতন কাটা হচ্ছে। এ নিয়ে কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। করোনা রোধে আড়াই মাস বন্ধ থাকার পর ১ জুন থেকে দেশের অভ্যন্তরে চালুর পর যাত্রীসংকটে একের পর এক ফ্লাইট বাতিল করছে সংস্থাটি। অথচ বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো এ সময় ঠিকই যাত্রী পাচ্ছে, ফ্লাইটও বাতিল হচ্ছে না। 

বিমান বিশ্লেষকরা বলছেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মার্কেটিং পলিসি খুবই খারাপ। সংস্থাটির কোনো জবাবদিহি নেই বললেই চলে। তাদের অনলাইন সেবাও ভালো নয়। টিকিট থাকার পরও তারা বলে দেয় টিকিট নেই। তাছাড়া অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় বিমানের টিকিটের দামও বেশি। মূলত এসব কারণে সংস্থাটি যাত্রী পাচ্ছে না। এদিকে বিমানের শীর্ষ পর্যায়ে রদবদল করেও লাভ হচ্ছে না। দুর্নীতির ছায়া থেকে মুক্ত হতে পারছে না সংস্থাটি।

এ প্রসঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মোকাব্বির হোসেন বলেন, বিমানকে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। সেই লক্ষ্যে কাজ করছি। আমরা পেছনের দিকে আর ফিরে যেতে চাচ্ছি না। বিমানে কোনো দুর্নীতিবাজের জায়গা হবে না। আশা করি, আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। তিনি বলেন, যাত্রী কম পাওয়া যাচ্ছে তা সত্য। ফ্লাইট বাতিল করা হচ্ছে। কারণ খালি ফ্লাইট চালালে তো আর লাভ হবে না। লোকসান আরও বাড়বে। বিজনেস পলিসি একান্তই প্রতিটি এয়ারলাইনসের ব্যাপার। আমি যদি কম যাত্রী নিয়ে চালাই তাহলে প্রতিটি ফ্লাইটে কমপক্ষে ২ লাখ টাকা লোকসান হয়। এভাবে যদি চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর ও সিলেটে কমপক্ষে দুটি করে ৬টি ফ্লাইট চালাই তাহলে দৈনিক ১২ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হবে। এটা করা ঠিক হবে? সময়ের অপেক্ষা করতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বেতন কর্তন করার অভিযোগ যারা করছে তাদের সঙ্গে কথা বলেন। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না।

এদিকে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বিমানের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে উঠে এসেছে। উড়োজাহাজ কেনা ও ভাড়া, রক্ষণাবেক্ষণ, টিকিট বিক্রি, কার্গো আমদানি-রপ্তানি, ক্যাটারিং খাতসহ বিমানের ৮টি খাতে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল দুদক। ওই প্রতিবেদন নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা চেষ্টা করছি বিমানকে রাহুর দশা থেকে মুক্ত করতে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্র্তৃপক্ষের (বেবিচক) এক কর্মকর্তা বলেন, একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরেই দরকার না থাকার পরও উড়োজাহাজ নিতে বাধ্য করছে বিমানকে। বিমানেই এ ধরনের লিজ হয়। ওয়েট লিজ হলে রক্ষণাবেক্ষণ, ক্রু, ইন্স্যুরেন্সসহ সব খরচ সংশ্লিষ্ট লিজদাতা কোম্পানি বহন করবে। গ্রহীতা শুধু অপারেট করবে। আর ড্রাই লিজে সব খরচ গ্রহীতা পরিশোধ করবে। বাংলাদেশে সাধারণত ড্রাই লিজে উড়োজাহাজ আনা হয়। তিনি বলেন, গত এক বছরে কয়েকটি বোয়িং কেনা হয়েছে। এগুলো কিনতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। করোনার কারণে বিমানগুলো বসে আছে। আবার অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চালু হওয়ার পরও যাত্রী পাচ্ছে না। এগুলো নিয়ে বিমানকে ভাবতে হবে। কীভাবে যাত্রী টানা যায় তার কৌশল বের করতে হবে। যেখানে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো যাত্রী পাচ্ছে, সেখানে বিমান কেন যাত্রী পাচ্ছে না তার কারণ উদঘাটন করতে হবে। বিমানের লোকসান কমিয়ে আনতেই হবে। আর না হয় এই সংস্থাটি টিকানো কঠিন হয়ে পড়বে।

বিমানের এক কর্মকর্তা বলেন, বিমানের প্রতিটি বদলি ও নিয়োগে টাকার খেলা চলে। যারা টাকা খরচ করতে পারেন তারা ভালো পোস্টিং পান। বিদেশে পোস্টিং পেতে আরও বেশি টাকা লাগে। ২০০৭ সালে বিমানকে কোম্পানি করার সময় ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রণ করার শর্ত দেওয়া হয়েছিল। কার্যত বিমানে ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রণে তো আসেইনি বরং সেই সময়ের তুলনায় এখন এর কার্যক্রম বেড়েছে বহুগুণ। ২০০৭ সালে ট্রেড ইউনিয়ন ছিল উন্মুক্ত। আর এখন ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রিত।

বেতন কাটা নিয়ে কর্মীদের ক্ষোভ : করোনার সময়ে বিমানের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন কাটা হচ্ছে। এই নিয়ে কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে প্রেষণে আসা ৫ শীর্ষ কর্মকর্তার বেতন কাটা হচ্ছে না। চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল বিমান পরিচালনা পর্যদের ২৩৮তম সভায় এই সিন্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে ৫ মে পরিচালক (প্রশাসন) জিয়াউদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে নতুন করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আদেশ অনুযায়ী বেতনক্রম ১ থেকে ৩ (২) পর্যন্ত কর্মকর্তাদের মোট বেতন (গ্রস স্যালারি) থেকে ১০ শতাংশ কর্তন করা হবে। বেতনক্রম ৪-৫ পর্যন্ত কর্মকর্তাদের ১৫ শতাংশ, ৬-৮ পর্যন্ত কর্মকর্তাদের ২০ শতাংশ এবং ৯ থেকে ওপরের কর্মকর্তাদের ২৫ শতাংশ বেতন কাটা হবে। অন্যদিকে পাইলটদের ক্ষেত্রে যাদের চাকরির বয়স ১ থেকে ৫ বছরের মধ্যে তাদের আউট স্টেশন অ্যালাউন্স কাটার পর যে বেতন থাকবে তার ২৫ শতাংশ কাটা হবে। যাদের চাকরির বয়স ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে তাদের ক্ষেত্রেও আউট স্টেশন অ্যালাউন্স কাটার পর যে বেতন থাকবে তার ৩০ শতাংশ কাটা হবে। এছাড়া যাদের চাকরির বয়স ১০ বছরের বেশি তাদের ক্ষেত্রেও একই নিয়মে মোট বেতনের ৫০ শতাংশ কাটা হবে। নতুন আদেশে আরও বলা হয়, বিমানে প্রেষণে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বেতন কাটা হবে না। তবে তারা অন্য কোনো সুবিধা পেয়ে থাকলে কিংবা বিমান থেকে বিশেষ ভাতা পেয়ে থাকলে সেখান থেকে ২৫ শতাংশ কাটা হবে। ক্যাজুয়াল কর্মীদের ক্ষেত্রে বেতন কাটা না হলেও তাদের বেতন-ভাতা মাসে ২২ দিন অনুসারে দেওয়া হবে। বিমানের প্রশাসনিক শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, করোনার কারণেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিমানের কোনো আয় নেই। করোনার জন্য আমাদের পর্যটনের সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিমানের শুধু এপ্রিল মাসেই বেতন, কিস্তি ও অন্যান্য ব্যয়ের জন্য দরকার ৬২৮ কোটি টাকা। মে মাসেও একই অবস্থা বিরাজ করছে।

এ প্রসঙ্গে বিমান শ্রমিক লীগের সভাপতি মো. মশিকুর রহমান বলেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কাটা হচ্ছে। এতে আমাদের বক্তব্য নেওয়া হচ্ছে না। বিমান এমডির সঙ্গে দেখা করার সময় চেয়ে তা পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি আমাদের সাক্ষাৎ দিচ্ছেন না। এক অফিসে দুই নিয়ম চলছে। প্রেষণে যারা এসেছেন তাদের বেতন কাটা হচ্ছে না। অথচ আমাদের বেতন কাটা হচ্ছে। তিনি বলেন, বেতন কাটার ফলে অনেকে চরম অনিশ্চতায় আছেন। এগুলো সুরাহায় মন্ত্রী ও সচিব মহোদয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com