এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে আসলে কে দেশ ছাড়লো?

0

মাসুদ কামাল

ধনাঢ্য ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদারের দুই পুত্র কোথায়? তারা কি দেশে নাকি বিদেশে? বিদেশে হলে- কিভাবে এই করোনাকালে দেশ ত্যাগ করতে পারলেন? এসব প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে।

রন হক সিকদার ও দীপু হক সিকদার- এই দুই চরিত্র এখন দেশের আইন ও প্রশাসনকে বিশাল এক প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। এদের বিরুদ্ধে গত ১৯ মে একটা মামলা হয়েছে গুলশান থানায়। এক্সিম ব্যাংকের এক পরিচালক সেই মামলার বাদী। সেই মামলার এজাহারের বিবরণের উপর নির্ভর করে মিডিয়াতে রিপোর্ট হয়েছে। রন হক কিভাবে এক্সিম ব্যাংক থেকে অবৈধ প্রক্রিয়ায় লোন নিতে চেয়েছিলেন, না পেয়ে ব্যাংকের এমডিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছেন- নির্যাতন করেছেন, এরকম নানা সিনেমাটিক বর্ণনা সেই রিপোর্টে রয়েছে। এজাহার যেহেতু একপক্ষের অভিযোগ, তাই এর পুরোটার উপর নির্ভর না করলেও চলে। আর তাছাড়া মামলা করা মানেই তো বিচার পাওয়া নয়। যে কেউই অন্য একজনের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন, দেশের আইন তাকে সে অধিকার দিয়েছে। কারও বিরুদ্ধে মামলা হলে, আইনমান্যকারী নাগরিক হিসাবে তার করণীয় কি? পালিয়ে বেড়ানো, নাকি আইনীপথে সে মামলাকে মোকাবেলা করা?

অনেক সময় এমন দেখা যায়, মিথ্যা মামলা করে নিরীহ ব্যক্তিদেরকে হয়রানী করা হয়। কিন্তু সিকদাররা নিশ্চয়ই নিরীহ নন। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। খোদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের ছবি প্রায়ই পত্রপত্রিকায় দেখা যায়। তাই সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে- তাহলে তারা কি অপরাধী? নাহলে কিসের ভয়ে, ক্ষমতা ও টাকার এত জোর থাকা সত্তে¡ও, কেন তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন?


মামলার পর থেকে পুলিশের মুখস্ত বাণী- তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশের এই খুঁজে না পাওয়ার পিছনে ক্ষমতা কিংবা অর্থ যে কাজ করতে পারে- এমন ধারণা অনেকের মধ্যে রয়েছে। মানুষ হয়তো ভাবছিল- এক্ষেত্রে কোনটা কাজ করছে? এরই মধ্যে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনে একটা সংবাদ প্রকাশিত হলো। বলা হলো- গত ২৫ মে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে একটি প্রাইভেট এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে থাইল্যান্ডে গেছে, যাতে দুইজন আরোহী ছিল। করোনার কারণে এখন বিমানবন্দরগুলো বন্ধ। এরই মধ্যে এই বিমানটি থাইল্যান্ডের এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার জন্য বাংলাদেশ থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভূমিকা রাখতে হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে থাই কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করতে হয়েছে।


চমৎকার এই প্রতিবেদনটির জন্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষ এবং তার প্রতিবেদককে ধন্যবাদ। তারা পাঠকদের অনেক কিছু জানিয়েছেন। কিন্তু তারা সেই তথ্যটিই জানাতে পারেননি- ওই দুই মহান ব্যক্তি কারা? অথচ এই তথ্যটির জন্যই পাঠকের উৎসাহ অপরিসীম। ওই দুই ব্যক্তি কি প্রখ্যাত অথবা কুখ্যাত ওই দুই সিকদার? তবে রিপোর্টে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য রয়েছে। তথ্যগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে- যা থেকে পাঠকের মনে ওই দুই ব্যক্তির পরিচয় সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হতে পারে। যে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি থাইল্যন্ডে উড়ে গেছে- সেটির মালিক ওই সিকদার গ্রæপ। তারা বলতে পারবেন- তাদের বিমানে কে গেলেন। কিন্তু তারা কোন কথা বলেননি। কোন দুই ব্যক্তি গেলেন, তা নিশ্চয়ই এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন বিভাগের জানার কথা। তাদের মাধ্যমেই তো যেতে হবে। কিন্তু তারাও নামদুটি প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণও এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজী নয়! অর্থাৎ যে যে তথ্য পেলে জানা যেত- ওই দুই ব্যক্তি আসলে কারা, সে সব তথ্যের দরজা বন্ধ করে রাখা হচ্ছে।


আইনের শাসন এবং তথ্য জানার অধিকারের কথা আমরা প্রায়ই শুনি। দেশে ’আইনের শাসন’ দারুনভাবে বিরাজ করছে বলে আমাদের মন্ত্রীগণ প্রায়ই গলার রগ ফুলিয়ে বলেন। কিন্তু এই যে দেশত্যাগী দুই ব্যক্তির নামই জানতে দেওয়া হচ্ছে না, এখানে জনগণের তথ্য জানার অধিকারটি কিভাবে পালিত হচ্ছে? অথবা যদি ওই দুইজন, বেপরোয়া দুই সিকদারই হয়ে থাকেন, তাহলে আইনের শাসনটি এখানে কিভাবে সমুন্নত থাকলো- এমন প্রশ্ন কিন্তু উঠতেই পারে।


মাঝে মধ্যে আমার মনে প্রশ্ন জাগে- আচ্ছা দেশটা আসলে কারা চালাচ্ছে? যে কোন মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করুন, আসলে জিজ্ঞাসা করার সুযোগই আপনি পাবেন না, তার আগেই নিজে থেকেই তিনি বলতে থাকবেন- সবকিছু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করছেন। এমন বলার মাধ্যমে তিনি যে কেবল প্রধানমন্ত্রীকে অতিমানবীয় ক্ষমতার অধিকারী হিসাবেই কেবল প্রতিষ্ঠিত করতে চান- তা কিন্তু নয়। একই সঙ্গে নিজের কৃত সকল ব্যর্থতা কিংবা অপকর্মের দায়ও প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রেও অনেকটা সেরকম মনে হচ্ছে। এর মধ্যেই একটি মিডিয়াতে দেখলাম- মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রন হক সিকদারের ছবি। এটা কি আজ বা গতকালকের ছবি? তা তো নয়। অনেক আগের ছবি। বঙ্গবন্ধুর ওপর একটা চলচ্চিত্র নির্মাণে সিকদাররা অর্থ সাহায্য করবে- সেই বিষয়ক ছবি। তাহলে আগের সেই ছবিটি এখন কেন প্রকাশিত হলো? এর দুটো কারণ থাকতে পারে, দুই ধরনের বার্তা মানুষকে দেওয়ার চেষ্টা হতে পারে। এক. “সিকদারদের নিয়ে বেশি কথাবার্তা বলো না, দেখ ওরা প্রধানমন্ত্রীর কত কাছের লোক।” অথবা দুই. “যে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা ও দৃঢ়তা নিয়ে তোমরা এত গর্ব করো, তিনিও ওদেরকে প্রশ্রয় দেন। উনি চেয়েছেন বলেই তো ওরা উড়াল দিতে পেরেছে।” আমার নিজের কিন্তু একটা তৃতীয় ধারণা রয়েছে। সেটা হলো, উড়ে যাওয়া দুই ব্যক্তি যদি আসলেই দুই সিকদার হয়ে থাকেন, তাহলে সে বিষয়ে কিছুই জানেন না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। অপকর্মটি যারা করেছে, তারা এখন নিজেদের চামড়া বাঁচাতে বিষয়টির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নাম জড়ানোর চেষ্টা করছে।


এই তিন ধারণার বাইরেও কিছু ধারণা থাকতে পারে। তবে হাইপোথেসিস বা থিওরি যা-ই থাকুক না কেন, ঘটনাগুলোর অন্তিম গন্তব্য কিন্তু ভালো কিছু ইঙ্গিত করে না।

আর সাধারণ মানুষ কিন্তু সেই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতেই থাকবে- আসলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশ থেকে কে গেল- দুই সিকদার নাকি আইনের শাসন?

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com