নতুন কথার ফাঁদ
এক রাজা তার রাজ্যে ঘোষণা করেছেন, যে ব্যক্তি তাকে তিনটি নতুন কথা শোনাতে পারবে তাকে অর্ধেক রাজত্ব দান করবেন। এ ঘোষণায় রাজ্যজুড়ে তোলপাড়। প্রজারা অর্ধেক রাজত্বের আশায় নতুন কথা নিয়ে হাজির হচ্ছেন রাজ দরবারে। রাজাও তার নবমরত্নকে নিয়ে গঠন করেছেন বোর্ড। এ বোর্ডের মুখোমুখি হচ্ছেন প্রজারা। কিন্তু কোনো প্রজাই নতুন কথা শোনাতে পারছে না। রাজাসহ নবমরত্ন সদস্যরা হতাশ। শেষ মুহূর্তে রাজ দরবারে প্রবেশ করলেন এক প্রজা।
বললেন, আমি শোনাবো নতুন কথা। সবাই এক বাক্যে বললেন কি তোমার নতুন কথা-শুনি। আমি সপ্তাহে একটি করে নতুন কথা শোনাবো আপনাদের। রাজা ও নবমরত্ন রাজি। প্রজা বলতে শুরু করলেন আমার গ্রামে দেখে এসেছি একটি শকুন মারা গেছে। আর এ শকুনকে খাওয়ার জন্য গ্রামের সকল গরু দড়ি ছিঁড়ে দৌড়ে যাচ্ছে মরা শকুনের কাছে। নবমরত্নের সদস্যরা কথা শুনে তাজ্জব। একজন বললেন, সারা জীবন শুনে এসেছি গরু মরলে শকুনের পাল গিয়ে এ গরু খায়। আর এখন শুনি মরা শকুন খেতে ছুটছে গরু! হ্যাঁ- এটা নতুন কথা।
চলে গেলেন প্রজা। কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তাহ জুড়েই প্রচণ্ড বৃষ্টি। বৃষ্টিতে সকল কাজ কর্ম বন্ধ। রাজ্য জুড়ে জলাবদ্ধতা। এ অবস্থায় নির্দিষ্ট দিনে প্রজা হাজির হলেন নবমরত্নের সামনে। নবমরত্নের এক সদস্য জিজ্ঞেস করলেন, এবার কি নতুন কথা নিয়ে এসেছো? বলো। প্রজা বললেন, সপ্তাহ জুড়ে বৃষ্টিতে গোটা রাজ্যই এখন অচল। আমার বাবা মৃত্যুর আগে বেশ ক’টি রোদের গাঁট্টি সিন্দুকে ভরে রেখে গেছেন। বলে গেছেন কখনো এমন হলে সিন্দুক থেকে যেন ২/১ গাঁট্টি খুলে দেই। তাহলে বৃষ্টি চলে যাবে। রোদ হাসবে রাজ্যজুড়ে। নবমরত্নের সদস্যরা হতবাক। সত্যিই তো এটি নতুন কথা। এমন কথা তো কখনো শুনিনি।
পর পর দুটি নতুন কথা বলা হয়ে গেছে। তৃতীয় নতুন কি কথা নিয়ে হাজির হবেন তা নিয়ে চিন্তিত প্রজা। অনেক ভেবে-চিন্তে উপায় একটা বের করলেন। তৈরি করতে থাকলেন বিরাট আকারের একটি গোলা। বাঁশ বেত দিয়ে তৈরি গোলা নিয়ে রওয়ানা দিলেন রাজ দরবারে। রাজা তার নবমরত্নকে নিয়ে দরবারে উপস্থিত। এ সময় হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলেন। বললেন, রাজা মশাই আমার বাবা ছিলেন বিরাট জমিদার। এক সময় আপনার বাবা আমাদের প্রয়াত রাজা খুব অভাবে পড়েছিলেন। রাজ্যজুড়ে অভাব ঘুচাতে তিনি দিশাহারা। এ সময় তিনি দারস্থ হয়েছিলেন আমার বাবার। আর এ সময় আমার বাবা ওই যে গোলা দেখছেন, সেই গোলা ভর্তি করে টাকা দিয়ে রক্ষা করেছিলেন আপনার বাবাকে। কিন্তু সে টাকাটা আজও দেয়া হয়নি। কথা শুনে নবমরত্নসহ রাজা হতবাক। যদি বলে না এটা কখনো শুনিনি, একেবারেই নতুন কথা, তাহলে প্রজার জয় হবে। আর দিতে হবে অর্ধেক রাজত্ব। যদি বলে এটা নতুন নয়, শুনেছি। তাহলে গোলা ভর্তি টাকা দিয়ে বাবার ঋণ পরিশোধ করতে হবে রাজাকে।
রাজার অর্ধেক সম্পত্তি বিক্রির টাকা দিয়েও এ গোলা ভরবে না। উভয় সংকটে পড়েছেন রাজা ও তার নবমরত্ন। করোনাকালে বাংলাদেশও এখন এমন উভয় সংকটে। সবকিছু স্বাভাবিক করে দিলেও বিপদ, আবার ছুটি বাড়ালেও বিপদ। একদিকে সবকিছু স্থবির হয়ে থাকলে চারদিকে শুরু হয় হাহাকার। আবার সবকিছু সচল করে দিলে চারদিকে রব উঠে, একি! করোনা সংক্রমণের সংখ্যা যখন বাড়ছে তখন এ কেমন সিদ্ধান্ত? সরকার যাবে কোনদিকে? কেউ কেউ বলছেন, শুরুটাই হয়েছে ভুলে ভুলে। ছুটি ঘোষণা করতে না করতেই ত্রাণের ঢালি নিয়ে নামতে দেয়া ছিল চরম ভুল। বাংলাদেশের এমন অভাব এখন আর নেই। দিনমজুরের ঘরেও এখন কমপক্ষে ১৫-২০ দিনের খাবার সংরক্ষিত থাকে। অথচ আমরা করলাম কি? মানুষের আবেদনের আগেই তাদের ডেকে আনলাম রাস্তায়। তুলে দিতে থাকলাম ত্রাণ। ফটোসেশনে মত্ত হয়ে গেলাম। ওইসব মানুষ আরো ত্রাণের আশায় রাস্তায়ই ঘর পেতে বসলেন। কোনো গাড়ি এলেই ঘিরে ধরেন। ত্রাণ ত্রাণ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। অথচ দুই সপ্তাহ পরে ত্রাণ দেয়া শুরু করলে এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হতো না। কথায় বলে, বাঙালি যত পায় তত চায়। এক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে। কই এখন তো ত্রাণ বিলানোর তোড়জোড় নেই। এখন তো হাহাকারও নেই। তাহলে কি বলবেন, সবাই ত্রাণ ঘরে মজুত করে রেখেছে? এমনটা হলেতো আরো ভালো। ছুুুুুুটি বাড়ানো যায়। কারফিউও দেয়া যায়। কোনো সমস্যা নেই। না! এখানেও সমস্যা। এই যে শুরু থেকে এতো প্রচারণা চালানো হয়েছে- ঘরে থাকুন। নিরাপদে থাকুন। সে সময়ই বাইরে মানুষের ঢল ছিল অলি, গলি, হাট বাজারে। আর মার্কেট খুলে দেয়ার পরতো যে যেভাবে পারে কেনা কাটায় নেমে পড়ে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ধার ধারেনি কেউই। মাওয়া ফেরিঘাটের চিত্র দেখে মানুষ ভয় পেয়েছে। কিন্তু কাউকে কি থামানো গেছে? রাজার নতুন তিন কথা শুনার মতোই ঘটনা। প্রথম দুটি নতুন কথা স্বীকার করলেও শেষ কথা শুনে সবাই থ’ বনে যায়। এখানে নতুন বললেও বিপদ, না বললেও বিপদ। বাঙালিও এখন নতুন এ কথার ফাঁদে পড়েছে। manabzamin