বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস : মানুষ ও মানবিকতা
একটা গল্প দিয়ে শুরু করে মূল লেখায় যেতে চাই।
একজন স্ত্রীকে বুদ্ধির ও মানবিক মূল্যবোধ পরীক্ষা করার জন্য তাকে মনে-মনে তার পছন্দের ১০ জনের একটি তালিকা তৈরি করতে বলা হলো। ভদ্র মহিলা ১০ জনের একটি তালিকা তৈরী করলেন।
এবার পরীক্ষাকর্তা ১০ জনের তালিকা থেকে পাঁচজনকে বাদ দিতে বললেন। তিনি নির্দেশ অনুযায়ী ১০ জনের তালিকা থেকে পাঁচজনকে বাদ দিলেন, থাকল পাঁচজন।
এরপর বলা হলো পাঁচজন থেকে দু’জন বাদ দিন। তিনি দু’জনকে বাদ দিলেন। থাকল তিনজন অর্থাৎ স্বামী, ছেলে ও মেয়ে।
এখন এই তিনজন থেকে আরো একজনকে বাদ দিতে বলা হলো।
ওই নারী তালিকা তৈরী করেছেন মনে-মনে। তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না- এই নির্দেশনা ছিল পরীক্ষাকর্তার।
এই তিনজন থেকে একজনকে বাদ দেয়া কঠিন । স্বামী, ছেলে, ও মেয়ে- তাদের মধ্যে থেকে কিকরে একজনকে বাদ দেবেন। কিন্তু বাদ যেহেতু দিতেই হবে, তাই শেষ পর্যন্ত চিন্তা করে মেয়েকে বাদ দিলেন। মনে করলেন, মেয়ে বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি চলে যাবে তাই মেয়েকে বাদ দেয়া যায়।
এবার পরীক্ষাকর্তা ভদ্র মহিলাকে আরো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করালেন। পরীক্ষক নিষ্ঠুরভাবেই নির্দেশ দিলেন, দু’জন থেকে একজনকে বাদ দিয়ে একজনকে বেছে নেবার জন্য।
পরীক্ষার্থী স্ত্রী স্তব্ধ হয়ে গেলেন, মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না, কপাল ঘামছে, চোখ দিয়ে পানি ঝরছে, শরীর কেমন করছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। চোখ বন্ধ।
এই পরীক্ষা বুদ্ধি ও মানবিকতার প্রকাশ পাবে ধৈর্যের সাথে বিচার বিবেচনা করে একজনকে বাদ দিতে হবে। হঠাৎ চোখ খুলে সিদ্ধান্ত জানালেন ঠিক আছে একজনকে বাদ দিলাম।
সিদ্ধান্ত জানিয়ে পাথরের মূর্তির মতো ঠায় বসে রইলেন।
পরীক্ষার্কতা কিছুক্ষণ নীরব থেকে ভদ্র মহিলাকে জিজ্ঞেসা করলেন, চূড়ান্ত তালিকা থেকে কাকে বাদ দিয়ে কাকে বেছে নিয়েছেন তার পরিচয় জানিয়ে কোন বিবেচনায় বাদ দিয়েছেন তার ব্যাখ্যা করুন।
আমরা সবাই মানুষ, তফাৎ মানবিক গুণাবলীর। মানুষের মধ্যে যদি মানবিক গুণাবলী না থাকে তাহলে এই দেহের কতটুকুই মূল্য থাকে? নিঃশ্বাস বন্ধ হলেই দুনিয়ার সবকিছুই শেষ তাই না? তারপরও কত হিসাব-নিকাশ, পাওয়া না পাওয়ার বেদনা, ভুল বুঝবুঝি, প্রতিহিংসা, একজন আর একজনকে চিরতরে শেষ করে দিতে দ্বিধাবোধ করেন না। আরো কত কী?
যাক সে কথা এবার চুড়ান্ত সিদ্ধান্তের বিষয় জেনে নেই।
চোখ বন্ধ রেখেই ওই নারী এক নিশ্বাসে বলে গেলেন :
শেষ দুজনের মধ্যে যারা ছিলেন তাদের একজন আমার স্বামী, আর একজন ছেলে। তার আগে তিনজনের তালিকায় ছিল স্বামী, ছেলে ও মেয়ে। তিনজনের মধ্যে থেকে মেয়েকে বাদ দিয়ে ছিলাম। এবার দু’জনের মধ্যে থেকে ছেলেকে বাদ দিলাম। এই বিষয়ে আমার বক্তব্য হলো, ছেলে যখন বিয়ে করে সংসারী হবে তখন তার দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে গিয়ে একসময় আলাদা হবে। তখন আমি, আমার শক্তি আমার স্বামী। আমরা পরস্পর পরস্পরের বোঝা ঘাড় পেতে বহন করি। স্বামী আমার অলংকার। আমি তার সঙ্গী প্রেরণার উৎস আমার বিবেচনায় মূল্যায়ন এর চেয়ে আর কিছু হতে পারে না।
পাঠক : যে কারণে এই গল্প “নারী মহীয়সী” উপমা এসেছে তার রূপের বৈশিষ্ট্য নয়, তার মানবিক গুণাবলীর কারণে। সংসারে নারীর ত্যাগ খাতায় যোগ ফল টেনে হিসাব দেয়া যাবে না।
একবার চিন্তা করুন এই নারী অথাৎ আমার গর্ভধারিণী মা, স্ত্রী, বোন সন্তান যে পরিবারে জন্ম নিয়ে রক্তে মাংসে বেড়ে উঠেছেন সেই পরিবার ছেড়ে স্বামীর কাছে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন অতীতের সবকিছু মুছে দিয়ে। আর এই মহীয়সী নারীকে মূল্যায়ন না করে আপনি সমাজে মহৎপ্রাণ পুরুষ হবেন কোন বিবেচনায়? কিছুতেই সম্ভব হবে না।
প্রতিটি নারীর মনস্তাত্ত্বিক চিন্তা প্রায় একরকম থাকে। তবে জীবন সংগ্রামে পথ পরিক্রমায় যে পরিবর্তন হয় তার পেছনের কারণগুলো যৌক্তিকভাবে সুবিবেচনার দাবি রাখে। অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় অধিকারের নামে মানবিক গুণাবলী হারিয়ে যাচ্ছে। তার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে এরকম পরিস্থিতির।
একটি দুটি ঘটনার উদাহরণ যথেষ্ট।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণে নারায়ণগঞ্জে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক স্ত্রী রোগী ইন্তেকাল হলে, তার স্বামী লাশ নিতে এলেন না। কয়েক দিন পর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিল সরকারি কবর স্থানে দাফনের ব্যবস্থা করেন। রাস্তায় স্ত্রী মারা গেলেন স্বামী লাশ রেখেই পালিয়ে গেলেন। মায়ের লাশ পরে আছে, সন্তান খোঁজ নিচ্ছেন না।
এই যে মানুষের বিবেক বোধ হারিয়ে যাচ্ছে তার দায় কে নেবে? আর কিভাবেই সমাজের রাষ্ট্রের কল্যাণে মানুষের বিবেক বোধ জাগ্রত হবে?
দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রনীতিকদের, গুণীজনদের সামষ্টিকগত বিবেচনায় নিয়ে। নিজে ভালো থাকবো এই মানসিকতা থাকলে সামনের কাতারে আসা যায় না। বর্তমান সঙ্কটে কয়জন বিত্তবান শ্রেণির পেশাদার ব্যাক্তি সামনের কাতারে এগিয়ে এসেছেন? এগিয়ে আসার মানবিকতার শক্তি ঈমান আর ইনসাফের মধ্যে দিয়ে।
মহামারি কারো কারো জন্য পরীক্ষাও বটে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : কোনো এলাকায় প্লেগের প্রভাবের খবর পেলে তোমরা সেখানে যেয়ো না এবং কোনো এলাকায় অবস্থান কালে সেখানে “প্লেগ লক্ষ্য করলে সেখান থেকে পালিয়ে যাবে না”। মুসলিম- ৫৬৬৬-(৯৩/..)।
আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সঙ্কট মোকাবেলা করেই তারপর চাই সবুজ প্রান্তরে সকলেই একত্রিত হতে।
মহান আল্লাহ সহায়।
আমিন।
লেখক : সহ-সভাপতি
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা
জাসাস