আর্থিক প্রণোদনায় বঞ্চিত কারা?

0

নভেল করোনাভাইরাস (কভিড-১০) বিস্তার এবং এর নেতিবাচক প্রভাব রোধকরণে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। নিঃসন্দেহে এসব উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। তবে দুর্যোগ মুহূর্তে এবং দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে কারা এবং কোন মাত্রায় প্রণোদনা পাওয়া উচিত সেসব বিষয়ে সুচিন্তিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। অর্থাৎ, দুর্যোগের নেতিবাচক প্রভাব রোধকল্পে কিছু মৌলিক নীতি অনুসরণ করলে সমাজ ও রাষ্ট্রের অধিক কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব। অন্যথায়, অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তি, সমাজ কিংবা প্রতিষ্ঠান সুবিধাবঞ্চিত থেকে যাবে। এ লেখা রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের ঘোষিত প্রথম ৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা বিষয়ে, যার মূল উদ্দেশ্য হলো ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা থেকে কারা এবং কী কারণে বঞ্চিত থাকবে তা তুলে ধরা। সরকার চাইলে এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রণোদনা কার্যক্রমকে আরো বেশি মাত্রায় অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পারে।

প্রণোদনা প্যাকেজে প্রথম যে ঘোষণাটি আসে তা হলো সচল রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত কেবল শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানের নিমিত্তে সরকার কর্তৃক বাজেট বরাদ্দ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা। এ প্রণোদনা আসবে অর্থ বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ থেকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক চাহিদা মোতাবেক সুবিধা প্রদান করবে। উল্লেখ্য, তফসিলি ব্যাংক এক্ষেত্রে ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জ আরোপ করবে। আমাদের বিবেচ্য বিষয় হলো এ প্রণোদনা কতটুকু অন্তর্ভুক্তিমূলক তা আলোচনা করা। প্রথমেই বলতে হয় সচল রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান বলতে কী বোঝায়? এক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। প্রথমত, যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান মোট উৎপাদনের ৮০ শতাংশ রফতানি করে। দ্বিতীয়ত, যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের শ্রমিক-কর্মচারীদের বিগত ডিসেম্বর ২০১৯, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি ২০২০-এর বেতন পরিশোধ করেছে। তৃতীয়ত, সচল রফতানিমুখী প্রতিনিধিত্বকারী বাণিজ্য সংগঠন যেমন বিজেএমইএ, বিকেএমইএ ইত্যাদি থেকে প্রত্যয়নপত্র দ্বারা সমর্থিত হতে হবে।

এসব শর্ত পূরণে অনেক রফতানিমুখী বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত হবে। প্রথমত, যারা মোট উৎপাদনের ৮০ শতাংশ রফতানি করে না, তারা প্রণোদনা প্যাকেজের বাইরে থাকবে। দ্বিতীয়ত, মোট উৎপাদনের ৮০ শতাংশ রফতানি করে কিন্তু কোনো কারণে উল্লেখিত কোনো এক মাসের বেতন দিতে পারেনি তারাও বঞ্চিত হবে। উল্লেখ্য, কভিড-১৯-এর কারণে জানুয়ারি মাস থেকে আমাদের রফতানি অর্ডার বাতিল হতে থাকে। এক্ষেত্রে, এসব কিছু প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা পরিশোধে অক্ষমতা থাকতে পারে কিনা, তা বিবেচনায় নেয়া যেতে পারত। তৃতীয়ত, প্রত্যয়নপত্রের বিষয়টি কিছুসংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে বঞ্চিত করতে পারে। কেননা এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্বকারীরা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে থাকে। আবার কিছু বাণিজ্য সংগঠনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, একই ব্যক্তি ক্ষমতার দাপটের কারণে একাধিকবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। তাছাড়া কতিপয় প্রতিষ্ঠানের মালিক, যাদের এ ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক, তারা শর্ত পূরণ করলেও প্রণোদনা সুবিধা ভোগ থেকে বাদ পড়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তার উৎপাদনের শতকরা ৮০ ভাগ রফতানির চিত্র পাওয়াও অনেক কঠিন কাজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ বাজার ও বহির্বাজার বিবেচনায় আনতে হবে। পাবলিক ডাটাবেজ ছাড়া সংগঠনভিত্তিক ডাটার ওপর নির্ভর করা হবে কিনা কিংবা কোন উেসর মাধ্যম ব্যবহার করা হবে, তাও সুনির্ধারিত নয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন তথ্যমাধ্যম ব্যবহারের সুযোগ নিতে পারে। এক্ষেত্রে বাণিজ্য সংগঠন প্রত্যয়নপত্র প্রণয়নে কোন তথ্যকে প্রাধান্য দেবে, তার ওপর নির্ভর করেও কিছু প্রতিষ্ঠান সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

এখন আমরা মূল কথায় আসি, মহামারীর কারণে রফতানি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত সব প্রতিষ্ঠানই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। লকডাউন অবস্থা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। অতএব এই বিচারে ঘোষিত প্রণোদনা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সবাই সমঅধিকার রাখে, যা ঘোষিত প্যাকেজে বিবেচনায় আসেনি। দ্বিতীয়ত, নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাব রফতানিমুখী বাণিজ্যের জন্য একটা দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি করেছে। আর এ সংকট মোকাবেলার লক্ষ্যে সচল রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে তারা সংকট মোকাবেলা করতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই এখানে বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত ছিল ওই সব রফতানিমুখী বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি সক্ষমতা নির্ণয় করা। যদি এক্ষেত্রে ঝুঁকি সক্ষমতা নির্ণয় করা না হয়, তাহলে অধিক সক্ষমতাসম্পন্ন রফতানিমুখী বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক প্রণোদনাপ্রাপ্ত হবে। তার বিপরীত ফলাফল পাওয়া যাবে অপেক্ষাকৃত কম সক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে। তবে ঝুঁকি সক্ষমতা বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে বিভিন্ন প্রায়োগিক গবেষণার ফলাফল থেকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ঝুঁকি মোকাবেলাসংক্রান্ত গবেষণায় দেখা যায় যাদের আয় অথবা সম্পদ বেশি, তারা অধিক মাত্রায় ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষম। অর্থাৎ, যেমন আমরা বলে থাকি, ধনীদের থেকে গরিবদের ঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা তুলনামূলক কম। অতএব আমরা বলতে পারি, যেসব রফতানিমুখী বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের নিট সম্পদের পরিমাণ বেশি বা টার্নওভার বেশি তাদের ঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা বেশি। অন্য বিবেচনায় বলা যায়, যেসব প্রতিষ্ঠানের পণ্যের বাজার বিস্তৃত সেসব প্রতিষ্ঠানের নিট সম্পদের পরিমাণ বেশি এবং টার্নওভারও বেশি। অতএব যেসব রফতানিমুখী বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান তার শতকরা ৮০ ভাগ পণ্য রপ্তানি করে তাদের পণ্যের বাজার অধিক বিস্তৃত, এমনকি এদের নিট সম্পদের পরিমাণও বেশি। এ বিবেচনা থেকে বলা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা অনেক বেশি। অন্যপক্ষে যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদনের শতকরা ৮০ ভাগের কম রফতানি করে, তারা যদিও অপেক্ষাকৃত দুর্বল, কম শক্তিশালী ও ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা কম, প্রণোদনা প্যাকেজে এসব প্রতিষ্ঠানকে ওই প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত করেছে। তাছাড়া ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজে ঋণখেলাপিদের ব্যাপারে কোনো ধরনের নির্দেশনা দেয়া হয়নি। ফলে এসব ঋণখেলাপি প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা নেয়ার মাধ্যমে প্রকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোকে বঞ্চিত করবে। যদিও সংকট মুহূর্তে প্রণোদনার সবচেয়ে দাবিদার সমাজের বা রাষ্ট্রের দুর্বল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু সরকার ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ কি এ বাস্তবতা বাস্তবায়নে সক্ষম?

ড. সাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বিআইজিডি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মো. সাইফুল ইসলাম, সহযোগী গবেষক, বিআইজিডি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com