বিনা চিকিৎসায় মরছে রোগী

0

সাধারণ অসুস্থতা নিয়েও হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা পাচ্ছে না অনেক রোগী। এমন অভিযোগ এখন হরহামেশাই শোনা যাচ্ছে। রোগীরা একাধিক হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তি কিংবা চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছে। অন্য দিকে সাধারণ জ্বর-সর্দি থাকলেও করোনা আতঙ্কে চিকিৎসা না দিয়ে রোগীদের করোনার জন্য নির্ধারিত অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। অমানবিক এমন আরো অনেক খবরই রয়ে যাচ্ছে অন্তরালে। গণমাধ্যমে যতটুকু সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে তাতেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা সহজেই আন্দাজ করা যাচ্ছে। এ অবস্থায় বৃহস্পতিবার বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সব রোগীর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে।

প্রতিকূল এই সময়ে করোনা উপসর্গ নিয়ে কোনো রোগী মারা গেলে তার পরিবার অন্যদের কাছ থেকে তো বটেই, কাছের আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকেও অন্য সময়ের মতো সান্ত্বনা কিংবা সহানুভূতি পাচ্ছেন না। করোনা আতঙ্কে এখন আমাদের মধ্য থেকে পারিবাবিক এবং সামাজিক মূল্যবোধও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কয়েকটি ঘটনা এমন অমানবিকতারই ইঙ্গিত বহন করছে।

রাজধানীর বনশ্রীতে ফ্ল্যাট বাসাতে পরিবার নিয়ে থাকেন খালেক মৃধা। তার ঠিক উল্টো পাশের ফ্ল্যাটেই থাকতেন মোশারফ শেখ। দু’জন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও প্রতিদিন অফিসে আসা-যাওয়া, ভোরে হাঁটতে যাওয়া, বাজার করা এমনকি নামাজের জন্য মসজিদে একসাথেই যাওয়া-আসা করতেন; কিন্তু হঠাৎ জ্বর নিয়ে কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান মোশারফ শেখ। করোনার এই সময়ে এক সপ্তাহের মধ্যেও ঘটনাটি ওই ভবনের ১৬টি ফ্ল্যাটের কেউই জানতে পারলেন না। এমনকি তিন ফুট দূরত্বের দরজার ভেতরে থাকা খালেক মৃধা বা তার পরিবারও কিছুই জানতে পারেনি। মোশারফ শেখের পরিবারের লোকজন নাকি করোনার অজুহাতে লাশ দাফনে প্রশাসনের বাধা কিংবা প্রতিবন্ধকতার ভয়ে উচ্চ শব্দে কান্নাকাটিও করেনি। গোপনে লাশ গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে রাতেই দাফন করা হয়েছে। এ দিকে নিকটতম প্রতিবেশী খালেক মৃধার পরিবারের লোকজনও করোনা আতঙ্কে মারা যাওয়া মোশারফের বাসায় খোঁজখবর কিংবা সান্ত্বনা দেয়ার জন্যও যেতে সাহস করেননি।

এমন অনেক ঘটনা ঘটছে যে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে নয় বরং সাধারণ জ্বর-সর্দির মতো উপসর্গ নিয়ে কোনো নিকটাত্মীয় মারা গেলেও তার বাড়িতে অন্যরা যেতে ভয় পান। নামাজে জানাজাতেও অংশ নেন না। কোথাও কোথাও নামাজে জানাজা এবং দাফনেও বাধার সৃষ্টি করছেন আত্মীয়-স্বজনরাই। করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে তার পরিবারের সদস্যদের মনে সাহস জোগাতে কিংবা সান্ত্বনা দেয়ার চিরাচরিত যে সংস্কৃতি আমাদের সমাজে বিদ্যমান ছিল সেটিও যেন উঠে যাচ্ছে।

প্রতিদিন অভিযোগ আসছে, বহু বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে এই বলে যে, কোনো বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক চিকিৎসা না দিলে লাইসেন্স বাতিলসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে হাসপাতাল মালিকরা বলেছেন, সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন এবং সমন্বয় ছাড়া শুধু হুমকি দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি করা যাবে না।

মুগদার এক রোগীর স্বজন অভিযোগ করেছেন, আমার দুলাভাই করোনার রোগী ছিলেন না। ওনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। কিন্তু আমরা হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তির সুযোগ পাইনি। এমন অনেক অভিযোগ শুধু মিডিয়াতেই নয়, ফেসবুকসহ অন্যান্য স্যোশাল মিডিয়াতে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে। মাত্র কয়েক দিন আগেই একজন অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকার কিডনি জটিলতায় অসুস্থ হলে তাকে নিয়ে স্বজনরা একের পর এক বেসরকারি এবং সরকারি হাসপাতাল ঘুরেছেন এবং সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। তার পরিবারের এমন অভিযোগের প্রেক্ষাপটে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা নিয়ে উদ্বেগের বিষয় আবার আলোচনায় এসেছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল মালিক সমিতির সভাপতি মবিন খান বলেছেন, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালগুলোর কোনোটির ব্যাপারেই আমার কাছে একটিও অভিযোগ আসেনি যে, তারা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে না বা রোগী ভর্তি করছে না। তিনি জানান, দেশে এখন বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের ৬৯টি হাসপাতাল রয়েছে। এ ছাড়া দেশে বেসরকারি খাতে শুধু হাসপাতাল ও ক্লিনিক আছে ১০ হাজারেরও বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল সম্পর্কিত বিভাগের পরিচালক আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, আমরা বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোকে যুক্ত করার জন্য মালিকদের সাথে কয়েক দফা আলোচনা করেছি। তাদেরকে অনুরোধ করেছি, তারা যেন করোনাভাইরাস ন্যাশনাল গাইডলাইন অনুসরণ করে এবং সেভাবে যেন রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থাপনাটা করে। কিন্তু তারা সেটি করছে না।

এ দিকে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সব রোগীর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ জনস্বার্থে এ রিট আবেদনটি দায়ের করেন। রিটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদেরকে বিবাদি করা হয়েছে। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চে রিটটি করা হয়েছে বলেও জানান আইনজীবী। আবেদনে করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবের সময় প্রতিটি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সব ধরনের চিকিৎসা দেয়ার পদক্ষেপ নিতে রুল জারির আর্জি জানানো হয়েছে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com