দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে ভয়ের পরিবেশ কাম্য নয়

0

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেছেন, বক্তব্য কিংবা কার্টুনের মাধ্যমে ভিন্নমত বা উদ্বেগ প্রকাশের দায়ে মানুষকে গ্রেপ্তার, অভিযুক্ত ও হয়রানি করা সত্যিই দু:খজনক ও ভীতিকর । এ থেকে বুঝা যায় সরকার নিজেদেরকে নিরাপদ ভাবছে না । এমন পরিস্থিতি সরকারের দুর্বলতার বহি:প্রকাশ। গতকাল রাতে এসব কথা বলেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী। তিনি বলেন, সমালোচকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন বা তাদের  গ্রেপ্তার না করে দায়িত্বশীল সরকারের উচিত মানুষের উদ্বেগগুলোকে বিবেচনায় নেয়া এবং স্বচ্ছতার পরিচয় দেয়া। বিশ্ব কেন তাদের সমালোচনা করছে তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করাও তাদের কাজ নয়।

মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, সাম্প্রতিক গ্রেপ্তারগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর শীতল প্রভাব ফেলবে, যা বাকস্বাধীনতার অধিকারকে নিরুৎসাহিত করবে। এটা সরকারের কোভিড-১৯ মোকাবিলার প্রক্রিয়াকেও বাধাগ্রস্থ করবে কারণ বৈশ্বিক মহামারি কোভিড -১৯ বা করোনা ভাইরাসের এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে সরকার ও সিভিল সোসাইটির মধ্যে স্বচ্ছতা ও সহযোগিতার মনোভাব থাকা প্রয়োজন, ভয়ের পরিবেশ নয়।

তিনি বলেন আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্যগত সংকট মোকাবিলায় প্রয়োগকৃত যেকোন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা অবশ্য আনুপাতিক অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও বিজ্ঞানসম্মত হতে হবে।

নিখোঁজ হওয়া সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার সাংবিধানিক স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত সুরক্ষার পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেন মীনাক্ষী গাঙ্গুলী। তিনি বাংলাদেশে বিতর্কিত ৫৪ ধারা নিয়ে আদালতের নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে বলেন, সিআরপিসি ৫৪ ধারায় পুলিশের আটক সংক্রান্ত ব্যাপারে আদালত সরকারকে যে নির্দেশনা দিয়েছিলো তা মানা হচ্ছে না। কাজলের গ্রেপ্তারের বিষয়ে এই নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশি নাগরিক হয়েও কাজল কেন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের দায়ে গ্রেপ্তার হন তা এখনও পরিষ্কার নয়। মানুষের জীবন, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকার ব্যাহত হওয়া এই ৫৪ ধারার ব্যবহার উদ্বেগের জানিয়ে মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, নিখোঁজ হওয়া সাংবাদিক কাজলের ফিরে আসাকে স্বাগত জানাচ্ছি। কিন্তু বাংলাদেশের আরও অনেক পরিবার তাদের নিখোঁজ হওয়া প্রিয়জনদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তাদেরকে খুঁজে বের করার জন্য তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

এদিকে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অধীনে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক গ্রেপ্তারের খবরে গত বৃহস্পতিবার ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার এক টুইট বার্তায় বলেন, সঠিকভাবে জনস্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য মুক্ত স্বাধীন গণমাধ্যম নির্ভরযোগ্য ও বাস্তবভিত্তিক তথ্য পরিবেশন করতে পারে, সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে বাক স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা এবং সাংবাদিকদের ঠিকমতো কাজ করতে দেয়া অত্যান্ত জরুরী। মার্কিন দূতের পাশাপাশি মুক্ত মতের চর্চা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতে বৃটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা ৭ রাষ্ট্রদূত পৃথক টুইট বার্তায় প্রায় অভিন্ন আহ্বান জানান। আমেরিকা ও ইউরোপের সাত দেশের রাষ্ট্রদূতরা টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘‘সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করে রাখার প্রয়াস নিলে তার ফল ভালো হবে না৷ এই সমস্যা সংকুল সময়ে বাকস্বাধীনতা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৷ ফেক নিউজ বড় ধরনের সমস্যা হলেও সাংবাদিকদের স্বাধীন ও মুক্তভাবে কাজ করতে দিতে হবে৷ জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য নির্ভরযোগ্য ও তথ্যভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম জরুরী৷’’

আলাদা আলাদা টুইট বার্তা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার, ইইউ’র রাষ্ট্রদূত রেনসে তেরিঙ্ক, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত হ্যারি ভেরওয়েজ, যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত রবার্ট ডিকসন, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত সিডসেল ব্লেকেন, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত শার্লোট স্লাইটার ও ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত উইনি এসট্রাপ পিটারসন ৷ পরদিন শুক্রবার ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অধীনে বাংলাদেশে নতুন গ্রেপ্তারের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর প্রিন্সিপ্যিাল ডেপুটি অ্যাসিস্যান্ট সেক্রেটারি এলিস ওয়েলস এক টুইট বার্তায় এই উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান। বাক স্বাধীনতাকে গণতন্ত্রের ভিত্তি হিসাবে অভিহিত করে মার্কিন মন্ত্রী এলিস ওয়েলস বলেন, এই মহামারির সময় মুক্তভাবে মত প্রকাশই মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারে।
অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন কূটনীতিকদের ওই বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, বিদেশিরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাক স্বাধীনতা ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি ৷ তিনি কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘনের সম্ভাব্য পরিণতির কথাও তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব যখন কোভিড -১৯ এর বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তখন একটি নির্দিষ্ট ইস্যুতে অভিন্ন বা প্রায় একই ধরণের মন্তব্য অনাকাঙ্খিত, অনভিপ্রেত।

গত ১০ মার্চ ‘পক্ষকাল’ সম্পাদক ও ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল নিখোঁজ হন। ৯ মার্চ দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, রিপোর্টার আল আমিন ও কাজলসহ অন্য ৩০ জনের বিরুদ্ধে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মামলা করা হয়। দেশীয় বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল ও সাংবাদিকদের অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) এর মতো তিনটি আন্তর্জাতিক সংগঠন সে সময় কাজলের অবস্থান শনাক্ত করে তাঁর নিরাপত্তা দেয়া এবং মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উল্লেখ্য, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে দমনের অস্ত্র হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার হতে পারে এই আশঙ্কায় একদম শুরু থেকেই সম্পাদক পরিষদ এই আইনের বিরোধিতা করে আসছে ।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com