ত্রিশ বছর পর ২-৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা

0

১০ বছরের বেশি সময় ধরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) টানা ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি পেয়ে আসছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃৃৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। কয়েক বছরের মধ্যে এটি দুই অংকে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার। কিন্তু সে লক্ষ্যের পথে বড় বাধা নিয়ে এসেছে বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাস। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস বলছে, করোনার প্রভাবে চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ২-৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে, যে চিত্রটি ৩০ বছর আগে দেখেছিল বাংলাদেশ। 

 ওয়াশিংটন সদর দপ্তর থেকে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলনের তথ্য প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির ‘সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস, স্প্রিং ২০২০: কার্সড ব্লেজিং অব পাবলিক ব্যাংক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ পূর্বাভাস দেয়া হয়। 

চলতি অর্থবছরের জন্য ২-৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হলেও আগামী অর্থবছরে তা আরো কমে ১ দশমিক ২ থেকে ২ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তবে ২০২১-২২ অর্থবছরে অর্থনীতি একটু ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তখন ২ দশমিক ৮ থেকে ৩ দশমিক ৯ শতাংশের মধ্যেই থাকতে পারে প্রবৃদ্ধি। 

বিশ্বব্যাংক বলছে, ছয় মাস ধরে দেশের রফতানি ও বেসরকারি বিনিয়োগে খারাপ পারফরম্যান্স চলছে। এর মধ্যেই আঘাত হেনেছে কভিড-১৯, যা বেসরকারি বিনিয়োগকে আরো খারাপ অবস্থায় নিয়ে যাবে। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। দেশজুড়ে চলমান বন্ধ পরিস্থিতিতে ব্যাপকভাবে কমে গেছে ব্যক্তিগত ভোগ, যেটাকে বলা হয় প্রবৃদ্ধির মূল ইঞ্জিন। অন্যদিকে রেমিট্যান্সপ্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় কমে গেছে রেমিট্যান্সনির্ভর পরিবারগুলোর ভোগ ব্যয়ও। সম্প্রসারমান মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি এবং খাদ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি হবে। রফতানি ও রেমিট্যান্স কমে গিয়ে ২০২১ সালে আরো বাড়বে চলতি হিসাবে ঘাটতি। ক্ষতি প্রশমনের যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া না হলে দারিদ্র্য আরো বেড়ে যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতি চারটির একটি পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে। এসব পরিবারের সদস্যরা নির্মাণ খাতসহ বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমের সঙ্গে যুক্ত। কভিড-১৯-এর কারণে এসব খাতে এরই মধ্যে ধাক্কা লেগেছে, যার প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়বে নির্ভরশীল পরিবারগুলোর ওপর। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বড় ধাক্কা আসছে বাংলাদেশের জন্য। 

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, গত কয়েক শতকের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, হয় চাহিদা নয় সরবরাহ দুর্বলতার কারণে বৈশ্বিক মহামন্দাগুলো হয়েছে। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের কারণে চাহিদা ও সরবরাহ দুটোতে ব্যাঘাত ঘটেছে। বাংলাদেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় বৈশ্বিক জোগান বিশেষ করে আমদানি যেমন বিঘ্নিত হয়েছে, তেমনি দেশীয় জোগানও ব্যাহত হচ্ছে। দেশের উৎপাদনশীল খাত অনেকটাই ম্রিয়মাণ। দেশে মোট ব্যয়ে ৬৯ শতাংশই ভোক্তা ব্যয়। এ ভোক্তা ব্যয়ের সিংহভাগই আসে দুটি উৎসবকে কেন্দ্র করে। কিন্তু সেই দুটি উৎসব এখন বন্ধের পথে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কেনাকাটা ছাড়া আর কোনো কেনাকাটা নেই বললেই চলে। 

অর্থনীতিকে জাগিয়ে রাখতে হলে তিনটি পদক্ষেপের সুপারিশ করেছেন এ অর্থনীতিবিদ। সুপারিশ তিনটি হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব কভিড-১৯ টেস্টিং, ট্রেসিং ও ট্রিটমেন্টের আওতায় আনতে হবে। পিছিয়ে পড়া মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করতে হবে দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আর সামনের কৃষি মৌসুমে উৎপাদন ঠিক রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশের ঘরে ছিল আশির দশকে। এরপর আর কখনই এমন চিত্র চোখে পড়েনি, যা চলতি অর্থবছরে দেখতে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বশেষ ১৯৮৯ সালে ২ দশমিক ৪৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ। তবে ’৯০-এ সামরিক সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯১ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশে উন্নীত হয়। ২০০৩ সালে ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশে উন্নীত হয় প্রবৃদ্ধির হার। ২০০৩ সালের পর বাংলাদেশে কখনই ৫ শতাংশের নিচে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়নি। কয়েক বছর ধরেই তা পর্যায়ক্রমে ৬ ও ৭ শতাংশের ঘর অতিক্রম করে সর্বশেষ গত অর্থবছর ৮ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার। দুই-তিন বছরের মধ্যেই দুই অংকের ঘরে পৌঁছানোর পরিকল্পনা ছিল সরকারের। কিন্তু বিশ্বব্যাংক বলছে, আগামী তিন অর্থবছর ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনই কঠিন হয়ে যাবে। করোনা পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে তাদের প্রক্ষেপণ আরো কমে আসতে পারে। 

সংস্থাটি বলছে, করোনা মহামারীর কারণে বাংলাদেশের বেশকিছু খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে পণ্যের চাহিদা কমবে অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ববাজারে। পাশাপাশি বেকারত্বও দারিদ্র্য সমস্যাকে আরো গভীর করে তুলতে পারে। 

বাংলাদেশ ও ভুটানের বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মের্সি টেম্বন বলেন, মহামারীতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা সংকটের সময়কাল ও মহামারী থেকে উত্তরণে গৃহীত প্রশমন ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করবে। বাংলাদেশ সরকার জনস্বাস্থ্যের দিকনির্দেশনা, উদ্দীপনা প্যাকেজ ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাড়িয়ে দ্রুত কাজ করছে। সরকারকে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়তা করার জন্য এ মাসের শুরুর দিকে বিশ্বব্যাংক ‘কভিড-১৯’ প্রাদুর্ভাব শনাক্ত ও প্রতিরোধ করতে ১০ কোটি ডলার অর্থায়নের অনুমোদন দিয়েছে। মহামারী মোকাবেলায় ও পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করতে এবং দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিস্থাপকতা তৈরিতে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বিশ্বব্যাংক। 

শুধু বাংলাদেশ নয়, নভেল করোনাভাইরাসের ধাক্কায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সাতটি দেশের অর্থনীতিতেও বড় রকমের ধস নামতে পারে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানের জিডিপি বাড়বে না। এসব দেশ সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ পর্যন্ত নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির মুখ দেখতে পারে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে চলতি অর্থবছরে চারটি দেশের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হবে। এর মধ্যে আফগানিস্তান মাইনাস ৫ দশমিক ৯ থেকে মাইনাস ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, মালদ্বীপ মাইনাস ১৩ শতাংশ থেকে মাইনাস সাড়ে ৮ শতাংশ, পাকিস্তান মাইনাস ২ দশমিক ২ শতাংশ থেকে মাইনাস ১ দশমিক ৩ শতাংশ এবং শ্রীলংকায় মাইনাস ৩ শতাংশ থেকে মাইনাস দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। এছাড়া চলতি অর্থবছরে ভারতের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ। আর নেপালে ১ দশমিক ৫ থেকে ২ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ভুটানে ২ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে প্রক্ষেপণ করেছে সংস্থাটি। 

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ হ্যানস টিমার জানিয়েছেন, কভিড-১৯ মোকাবেলার পর সার্বভৌম ঋণ ব্যবস্থাপনা টেকসই করতে হবে। এজন্য কার্যকর রাজস্ব নীতি এবং ঋণ পরিত্রাণের উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমান সংকটের বাইরের দৃষ্টিভঙ্গি দিতে হবে। এছাড়া সম্ভাব্য সুযোগগুলো বিশেষ করে লেনদেন পরিশোধে ডিজিটাল প্রযুক্তির সম্প্রসারণ করতে হবে।

কভিড-১৯ মহামারীর কারণে ক্রমবর্ধমান মানবিক ক্ষতি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিণতির মধ্যে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার সরকারগুলোকে স্বাস্থ্য খাতে জরুরি ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, তাদের (সরকার) জনগণ, বিশেষ করে দরিদ্রতম ও হতদরিদ্র মানুষকে রক্ষা করতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় আটটি দেশের প্রতিটি দেশ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়া, বাণিজ্যিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়া এবং আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে আরো বেশি চাপের কারণে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পড়বে। ২০২০ সালে আঞ্চলিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৮ থেকে ২ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে। ফলে গত ৪০ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলের সবচেয়ে খারাপ প্রবৃদ্ধি হতে যাচ্ছে। 

দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্টিগ শ্যাফার বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সরকারগুলোর জন্য অগ্রাধিকার হলো ভাইরাসটির ছড়ানো প্রতিরোধ করা। পাশাপাশি দেশের মানুষকে রক্ষা করা। দরিদ্র মানুষ যারা স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য আরো খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। কভিড-১৯ সংকট এ জরুরি বার্তা দিচ্ছে যে উদ্ভাবনী পদক্ষেপ নিতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিগুলোকে সংকট শেষ হওয়ার পর ‘জাম্প স্টার্ট’ শুরু করতে হবে। এটি করতে ব্যর্থ হলে এ যাবৎ কালের অর্জন বিফলে যাবে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com