ভারতের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ
ভারতের মুসলিমবিরোধী ভাবাবেগ সহিংসতায় পরিণত হওয়াটা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
যে দেশটি ঐতিহাসিকভাবে তার বৈচিত্র্য ও সহিষ্ণুতার জন্য এবং বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের জন্য গর্ব করত, সেই দেশটিই সাম্প্রতিক সময়ে উৎকট স্বাদেশিকতা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও মাঝে মাঝে চরম সহিংসতার মতো ঠিক বিপরীত চরিত্র প্রকাশ করছে।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবারের মতো ভারতে সরকারি সফরে দিল্লি আসার এক দিন আগে সবশেষ দফার সহিংসতা শুরু হয়।
হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের, বিশেষ করে ২০১৪ সাল থেকে ভারত শাসনকারী বিজেপির সমর্থকদের মধ্যে ট্রাম্প অত্যন্ত প্রিয় চরিত্র।
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ভারতীয় রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করেছে। অবশ্য, এই উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনটি ভারতীয় সমাজে যে ক্ষতি করেছে, তা ১৯৪৭ সালে দেশের স্বাধীনতার পর থেকে নজিরবিহীন।
বিজেপির শাসনে অন্যান্য সংখ্যালঘু গ্রুপসহ ২০ কোটির বিশাল সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে অনেক বছর ধরে বাড়তে বিদ্বেষ আন্দোলনটির (আদর্শ ও নৈতিকভাবে দেউলিয়ার শিকার) মূলধারায় পরিণত হয়েছে।
ইসলামফোবিয়ার গড্ডালিকাপ্রবাহে (যা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে হামলার পর ব্যাপকভাবে বেড়েছে) ঝাঁপ দিয়ে দিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ অংশ হিসেবে তাদের বর্ণবাদী ও উগ্র স্বাদেশিক মতাদর্শকে আড়াল করেছে।
ফলে ডানপন্থী ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মতো সমমনা ইসলাফোবের কাছে মোদির ছুটে যাওয়াতে বিস্ময়ের কিছু নেই। মোদি-নেতানিয়াহু দৃশ্যমান অভঙ্গুর ‘বন্ধুত্ব’ হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে ইসরাইলপন্থী আন্দোলন বাড়তে থাকার বিষয়টিই প্রকাশ করছে।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শী ও ইসরাইলপন্থী জায়নবাদীরা অনেক আগেই অভিন্ন স্বার্থ আবিষ্কার করেছে। বর্ণবাদী শ্রেষ্ঠত্ব ও ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতার সামষ্টিক অনুভূতির দিক থেকে এমনটা হওয়াই ছিল স্বাভাবিক।
বস্তুত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে ও বিশ্বজুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উগ্র ডানপন্থী গ্রুপগুলোর মধ্যে অভিন্ন বিভাজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। অবাক করা হলেও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এসব গ্রুপের কয়েকটি ইহুদিবিদ্বেষী ও স্পষ্টভাবে সেমেটিকবাদ বিরোধী হিসেবে পরিচিত। অবশ্য এসব গ্রুপের কাছে অভিবাসনবিরোধী, উদ্বাস্তুবিরোধী ও মুসলিমবিরোধী ভাবাবেগ অন্য সবকিছুর চেয়ে অনেক বেশি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়।
বিশ্বজুড়ে ইসলামফোবিয়ার উত্থানবিষয়ক রাজনৈতিক বিশ্লেষণে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা অনেক বেশি নজর পেলেও ভারত, বার্মা, চীনের মতো দেশগুলো আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
এটাও সত্য যে চীনের ইউঘুর মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বার্মার রোহিঙ্গা সম্প্রদায় ও ভারতের মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও সহিংসতা তুলনামূলকভাবে ভালো রকমের মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে, বিশ্লেষণ করা হয়েছে। অবশ্য এসব রাজনীতিতে মুসলিমদের টার্গেট করা মোটামুটিভাবে সাময়িক ‘সঙ্ঘাত’ হিসেবে ধারণা করা হয়। তাদের মতে, এগুলো এসব এলাকার সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনা এবং বৈশ্বিক মুসলিমবিরোধী ধারার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।
কিন্তু এর চেয়ে বড় মিথ্যা আর কিছুই হতে পারে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিজেপির রাজনীতিবিদেরা প্রায়ই যেভাবে ভারতের মুসলিম অভিবাসীদের ‘অনুপ্রবেশকারী ও উইপোকা’ হিসেবে অভিহিত করে তা বার্মার বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী ও ফিলিস্তিনে ইসরাইলি জায়নবাদীদের অবমাননাকর শব্দাবলীর মতোই।
এ কারণেই ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের সমাবেশে লাখ লাখ লোক হওয়াটা কোনোভাবেই বিস্ময়কর নয়। ওই সমাবেশকে ইতিহাসের ‘বৃহত্তম ইসরাইলপন্থী সমাবেশ’ হিসেবে অভিহিত করেছিল সংগঠকেরা।
কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে নয়া দিল্লিতে যা হয়েছে, তা অতীতের অন্য যেকোনো সহিংসতার চেয়ে অশুভ ইঙ্গিতপূর্ণ। ক্রুদ্ধ হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা কয়েক ডজন ভারতীয় মুসলিমকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, আরো শত শত লোককে আহত করেছে।
ভারতে দাঙ্গাবাজদের সহিংসতা নতুন কিছু না হলেও সাম্প্রতিক সময়ের রক্তপাতকে খুবই আশঙ্কাজনক বিবেচনা করা হচ্ছে বিজেপি ও তাদের সমর্থকদের বর্ণবাদী অবস্থানের কারণে।
এ কারণেও এটি আশঙ্কাপূর্ণ যে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী হয় ভারতীয় মুসলিমদের ওপর নৃশংসতার সময় তা প্রত্যক্ষ করেছে কিংবা আরো খারাপ বিষয় হলো তারা নিজেরাই তাতে অংশ নিয়েছে।
যদিও যৌক্তিকভাবেই বলা হয় যে মোদির নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ভারতের কোটি কোটি মুসলিমকে রাষ্ট্রহীন করা) ফলে ভারতে মুসলিমবিরোধী প্রচারণার সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু আসল কারণ নিহিত রয়েছে বিজেপির মধ্যেই। এই দলটি রাজনৈতিক ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য গরিব ও প্রান্তিকদের দুর্দশাকে পুঁজি করে গড়ে ওঠেছে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মোদি ও বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে ভারত আগামী দিনে আরো খারাপ অবস্থার দিকে যাবে। তেল আবিব ও ওয়াশিংটনে থাকা একই ধরনের বর্ণবাদী ও সহিংস মিত্রদের সমর্থন পেয়ে মোদি দেশটির নাজুক সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অশুভ ও বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার শক্তি লাভ করে যাবে।
ভারতের পরিস্থিতি এবং আরো বড় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মুসলিমবিরোধী রাজনীতি ও সহিংসতাকে বোঝা আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন ভারতীয় মুসলিমদের অনেক বেশি সংহতি লাভ প্রয়োজন, বিশেষ যখন বিজেপি ও তাদের উগ্র স্বাদেশিক নেতাদের কোনো নৈতিক সীমা-পরিসীমা নেই বলেই মনে হচ্ছে।