মোদি হঠাৎ কেন সার্কের দ্বারস্থ হলেন?
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শুক্রবার নোভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে অভিন্ন কৌশল গ্রহণের লক্ষ্যে দক্ষিণ এশিয়া সহযোগিতা সংস্থা সার্কের নেতৃত্বকে একটি ভিডিও কনফারেন্সের আহ্বান জানালে তা বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। এই প্রস্তাবে সার্কের সব সদস্য দেশ ইতিবাচকভাবে সাড়া দেয়। একমাত্র পার্থক্য ছিল এই যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বদলে দেশটির কার্যত স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাফর মির্জা কনফারেন্সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। মোদির এই উদ্যোগ পাকিস্তানকে এই অঞ্চলে নিঃসঙ্গ করার লক্ষ্যে সার্ককে অগ্রাহ্য করার নীতির পরিত্যাগ। গত কয়েক বছরে পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে আঞ্চলিক অনেক গ্রুপ প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন মোদি।
১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সার্ক ছিল দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম আঞ্চলিক সংস্থা। এর উদ্দেশ্য ছিল সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক অর্থনীতিকে একীভূত করা। অবশ্য পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বৈরী সম্পর্কের কারণে সংস্থাটি কখনো তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। ২০১৪ সালে নেপালে সর্বশেষ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পরের সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালে নভেম্বরে। কিন্তু ভারত তাতে উপস্থিত হতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে তা বাতিল করা হয়। তার পর থেকেই সংস্থাটি আক্ষরিকভাবেই অকার্যকর হয়ে পড়ে। শীর্ষ সম্মেলনটি আয়োজনের আর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি, অবশ্য পাকিস্তান বলে আসছিল যে ভারতই বাধা।
এই প্রেক্ষাপটে এখন প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে যে ভারত দীর্ঘ দিন ধরে যে সার্ককে মৃত বিবেচনা করে আসছিল মোদি হঠাৎ করে কেন এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারলেন? দৃশ্যমান কারণ অবশ্যই করোনাভাইরাস। তবে তার উদ্যোগের পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয় অনেকে মনে করছেন।
দেশে মোদির বিভেদসূচক নীতির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দিল্লিতে সাম্প্রতিক নির্যাতনের ফলে (এতে উগ্রপন্থী হিন্দুরা মুসলিমদের ওপর নিধনযজ্ঞ চালায়) এমনকি ভারতের মিত্ররা পর্যন্ত মোদি সরকারের সমালোচনা করে। আন্তর্জাতিক মিডিয়া বারবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে থাকে যে মোদির সরকার সম্ভবত ইহুদিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনাকারী অ্যাডলফ হিটলারের নীতি অনুসরণ করছে।
কেবল মুসলিমবিরোধী নীতিই নয়, কাশ্মিরিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম দমনের জন্য মোদির শক্তিপ্রয়োগের নীতিও পাশ্চাত্যের মিডিয়া এবং এমনাকি তার নিজস্ব মিত্রদের কাছ থেকে মারাত্মক সমালোচনায় পড়ে ভারত। ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল (এর মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চলকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল) ভারতের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকারী কাশ্মিরি রাজনীতিবিদদেরও দূরে ঠেলে দেয়। ভিন্নমত দমনের জন্য পাশবিক শক্তির প্রয়োগ ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করা সত্ত্বেও মনোরম উপত্যকাটি এখনো ভারতীয় নিয়ন্ত্রণে আসেনি। অবশ্য ভারত কখনো প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও মোদির মুসলিমবিরোধী নীতি ও কাশ্মির পরিস্থিতির অব্যবস্থাপনা হিতে বিপরীত হয়েছে। পাকিস্তানকে নিঃসঙ্গ করতে চাওয়ার ভারতীয় নীতিও ফলপ্রসূ হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের ব্যাপারে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি পুনঃবিবেচনা ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। সার্ক প্লাটফর্মে কাজ করার ইঙ্গিত দিয়ে মোদি এই বার্তা পাঠালেন যে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক সংশোধন করতে চায় ভারত। বস্তুত, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য অভিন্ন মিত্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে তার আবার সম্পৃক্ত হওয়ার আগ্রহের বার্তাও দিয়েছে। অবশ্য নয়া দিল্লির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে ইসলামাবাদ।
পাকিস্তানের এই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে এই ধারণায় যে এই পর্যায়ে ভারতের সাথে যেকোনো ধরনের সম্পৃক্ততার অর্থ হলো কাশ্মিরে ভারতীয় পদক্ষেকে অনুমোদন করা। পাকিস্তানও অনুভব করে দিল্লির সাম্প্রতিক দাঙ্গা ও কাশ্মিরে অব্যাহত অস্থিরতার কারণে মোদি তার দেশে বর্তমানে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন, তাতে করে পাকিস্তান সম্পৃক্ত হলে ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক চাপ সরাতে তা মোদিকে সহায়তাই করবে।
এসব কৌশলের ব্যাপারে পাকিস্তান সচেতন এবং মোদির বোকামির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণের ‘কৌশলগত সম্ভাবনা’ থাকার সময়ে এই টোপ গ্রহণ সম্ভবত করবে না পাকিস্তান।
তবে মোদির এই আহ্বান নতুন মাত্রার সৃষ্টি করেছে এবং আগামী দিনগুলোতে কী হয় তা দেখার বিষয়।