পাম অয়েল গেম এবং মাহাথির

0

পাম অয়েল ব্যবসায় থেকে রাজনীতির ভাষায় পরিণত হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মালয়েশিয়ার বিগত প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের রাজনৈতিক বক্তব্যের কারণে মালয়েশিয়া থেকে পাম তেল আমদানি স্থগিত করেছেন।

মালয়েশিয়ার সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ কাশ্মিরে ভারতের ‘অ্যাকশন’ এবং সিটিজেনশিপ আইন নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন। মোদি সরকার পাম তেল ক্রয় না করার নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও মালয়েশিয়া একই অবস্থানে রয়েছে। মাহাথির বলেন, ‘অবশ্যই আমরা শঙ্কিত। আমাদের দেশ ভারতে প্রচুর তেল রফতানি করে। তাই বলে কেউ অন্যায় করল আর আমরা টাকার চিন্তা করলাম, এটা সঠিক নয়’। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন একথা।

ভারত মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় পাম তেল আমদানিকারক। মালয়েশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ পাম তেল উৎপাদন ও রফতানিকারক দেশ, প্রথম ইন্দোনেশিয়া। ভারত মালয়েশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম পাম তেল আমদানিকারক। নয়াদিল্লি সব আমদানিকারককে ‘প্রাইভেটলি’ পণ্য আমদানি করতে নিষেধ করেছে। ভারত প্রয়োজন মিটাতে বেশি দাম দিয়ে ইন্দোনেশিয়া থেকে কেনা শুরু করেছে পাম অয়েল। রয়টার্স জানায়, ‘সরকারিভাবে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।’ সমালোচকরা বলছেন, এটা আরো খারাপ কূটনীতি। নাগরিকত্ব বিল, সিএএ প্রসঙ্গে মাহাথির বলেন, ‘নির্যাতিত সংখ্যালঘু তা পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা আফগানিস্তানের হোক না কেন মুসলিম না হলে ভারতে নাগরিকত্ব পাবে, এটি নিপীড়ন মূলক।’ ভারতের তেল কূটনীতির প্রতিবাদে মাহাথিরের মিডিয়া উপদেষ্টা এ কাদের জসিম বলেন, ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুর নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। মালয়েশিয়ায় যেসব ভারতীয় কাজ করছে তাদের দেশে পাঠিয়ে দেয়া উচিত।’

দাতুক সেরি কাদির ফেসবুকে বলেন, ‘শত শত বছর ধরে আমরা ভারতীয় অভিবাসীদের জায়গা দিয়েছি। এদের অনেকে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ভারতীয় হাইকমিশনের হিসাব মতে, এক লাখ ৫০ হাজার ভারতীয় কর্মজীবী প্রবাসী মালয়েশিয়ায় আছেন। ভারত তবুও যখন গেম খেলতে চায় তাদের বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। ভারত থেকে যেসব খাবার কিনি সেগুলো এখানে উৎপাদন করার নির্দেশ দিয়েছি।’ ভারতীয় বংশোদ্ভূত মাইক্রোসফট সিইও সত্য নাদেলা বলেন, ‘আমি খুবই ব্যথিত যে, ধর্মভিত্তিক বিভাজন নিয়ে আমার দেশে আইন তৈরি হয়েছে।’

২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদি পূর্বের দেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের ‘লুক ইস্ট’ নীতি গ্রহণ করেছেন। তখন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নাজিব রাজাক। ২০১৮ সালে মাহাথির সরকার গঠন করেন ও পররাষ্ট্রনীতিকে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি, কুয়ালালামপুরকেন্দ্রিক বিশ্ব মুসলিম জোট, ধর্মপ্রচারক ডা: জাকির নায়েককে ভারতের হাতে তুলে না দেয়া, কাশ্মিরের মুসলমানদের পক্ষে অবস্থান নেয়া, সিএএ’র বিরোধিতা করা ছাড়াও জাতিসঙ্ঘে কাশ্মির পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে সমর্থন করে ২৭ সেপ্টেম্বর মাহাথিরের বক্তব্যে ভারতকে ‘আক্রমণকারী’ ও ‘অবরোধকারী’ হিসেবে আখ্যা করা হয়েছে। ভারত ‘পাম তেল তীর’ ছুড়ে দিলে ভারত-মালয়েশিয়ার সুসম্পর্কে ফাটল ধরে।

সম্পর্কোন্নয়নের জন্য মালয়েশিয়া ভারত থেকে এক লাখ ৩০ হাজার টন কাঁচা চিনি আমদানি করছে। এর মূল্য ৬৬.৪ মিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে, ভারত থেকে ৮৮ হাজার টন কাঁচা চিনি আমদানি করেছিল। ভারত গত বছর মালয়েশিয়া থেকে ৪.৪ মিলিয়ন টন কাঁচা পাম তেল আমদানি করেছে। অর্থ বছরের এ পর্যন্ত মালয়েশিয়া ভারতে রফতানি করেছে ১০.৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য; আমদানি হয়েছে ৬.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। ভারত বিশ্বে সবচেয়ে বড় চিনি উৎপাদনকারী দেশ। চলতি বছর ভারত রেকর্ড পরিমাণ, অর্থাৎ পাঁচ মিলিয়ন টন চিনি উৎপাদন করতে যাচ্ছে।
উভয় দেশ ২০১০ সালে কমপ্র্রিহেনসিভ ইকোনমিক কো-অপারেশন এগ্রিমেন্ট, সিইসিএ, স্বাক্ষর করেছে। এর আওতায় ভারত ট্যাক্স কর্তন করে মালয়েশিয়ার তেল আমদানি ৭২৭ শতাংশ উন্নীত করেছে। এখন এই বিরোধ আরসিইপি নামের পার্টনারশিপের ওপর পড়বে।

অবরোধ অব্যাহত থাকলে রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ বা আরসিইপির উদ্দেশ্য দারুণভাবে ব্যাহত হবে। এর চূড়ান্ত পর্বের আলোচনা থেকে ভারত নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। আসিয়ান ১০টি দেশ ও অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া আরসিইপিতে রয়েছে। এ থেকে ভারতের বের হয়ে যাওয়ার কারণ কী? মন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেছেন, আরসিইপির বাইরে থেকেও ভারত ভালো ব্যবসা করতে পারবে। গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন পূর্ণতা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও সামর্থ্যানুসারে কাজ শেষ করা সোজা ব্যাপার নয়। সুরেশ মিথুন মিত্র ইন্ডিয়া ল জার্নালে লিখেছেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, সহজভাবে ব্যবসা করা, স্বচ্ছতা, বাজারের ভেতরের বিষয়গুলোতে ঢোকা ইত্যাদি সহজ করতে হবে।

২০ চ্যাপ্টারের প্রকাণ্ড এফটিএ লিখতে সাত বছর চলে গেছে। ২০১২ সালে শুরু হওয়া এফটিএ ভারতকে ছাড়াই সামনে চলতে চায়। বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রসারে আসিয়ান অর্থনীতির সুষ্ঠু প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ। ভারত অবশ্য যেকোনো সময় ফিরে আসতে পারে, স্বাক্ষর করতে পারে। হিসাবে দেখা গেছে- বিশ্ব জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ এবং বৈশ্বিক জিডিপির ৩৯ শতাংশ আরসিইপির অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ভারতকে ছাড়া এর পরিমাণ ৩০ শতাংশ কমে যাবে। যতটুকু জানা যায়, চীনের আধিপত্যের জন্য ভারত সংস্থাকে এড়িয়ে চলতে চায়। মিত্র জোর দিয়ে বলেছেন, এমন একটি আঞ্চলিক বাণিজ্য ফোরামে ভারতের যোগ দেয়া উচিত।

মাহাথির কাশ্মির নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে দেশটি একা নয়। ভারতকে সেটাও বুঝতে হবে। ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে এত বড় বিষয় চাপিয়ে রাখা সম্ভব নয়। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারও কাশ্মিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমালোচনা করে জরুরি ব্যবস্থা নিতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ধর্মীয় বিষয় নিয়েও সঠিক আচরণের আহ্বান জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে শুনানি হয়েছে। সিভিল সোসাইটি দল মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদকে নাৎসিবাদের সাথে তুলনা করেছে। ভারতের ভেতরেও অসন্তোষ দানা বেঁধেছে। তামিলনাডু কংগ্রেস কমিটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে পাম তেল আমদানি বন্ধ না করার আহ্বান জানিয়েছে। তারা মনে করেন, তামিলনাডুর হাজার হাজার লোক, যারা মালয়েশিয়ায় কাজ করছেন, তারা রাজনৈতিক সমস্যায় পড়তে পারেন। ভারতীয় কমিউনিটিও বিপদাপন্ন হতে পারে। মাহাথির এই বিরোধকে ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য ভারত থেকে চিনি এবং মহিষের গোশত আমদানি বৃদ্ধি করেছেন। উভয়পক্ষ নমনীয় না হলে পরিস্থিতির আশু সমাধান হচ্ছে না।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com