তারুণ্যের ক্ষমতারোহণের গৃহদাহ?
সৌদি আরবে এখন চাঞ্চল্যকর সব ঘটনা ঘটছে। কেন এসব ঘটছে আর এর পরিণতিই বা কীÑ এসব নিয়ে নানা বিশ্লেষণ হচ্ছে। সামরিক কর্মকর্তাসহ আটক ২৯৮ জন সরকারি কর্মচারীকে দুর্নীতি দমন সংস্থা নাজাহা বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত করবে বলে জানিয়েছে। নাজাহা টুইট করেছে, সংস্থাটি এই ২৯৮ জনকে ১০১ মিলিয়ন ডলারের ঘুষ, আত্মসাৎ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অপরাধে অভিযুক্ত করছে।
গত ৬ মার্চ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা সৌদি রাজপরিবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এবং বিপুলসংখ্যক সামরিক-বেসামরিক আমলাকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছে। এটি দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে আবার বৈশ্বিক এজেন্ডার সামনে ফিরিয়ে এনেছে।
২০১৭ সালে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নিয়োগের পরে, আমরা রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভয় দেখানোর বিষয়টি ধারাবাহিকভাবে প্রত্যক্ষ করেছি। এ সময় অনেক সিনিয়র প্রিন্সকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এই অভিযানে যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানকে ‘আইনি ব্যবস্থা’ হিসেবে দেখানো হয়।
এ সময় সৌদি মন্ত্রী, প্রিন্স ও ব্যবসায়ীসহ আল ওয়ালিদ বিন তালালের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আটক করার কথা বলা হয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ হিসেবে। তাদের কয়েক মাস ধরে রিয়াদের রিটজ-কার্লটন হোটেলে আটক রাখা হয়েছিল। আর তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারের পরোয়ানা দুর্নীতি দমন কমিশন জারি করেছিল।
অন্য দিকে, এবার গত শুক্রবারের অভিযানে গ্রেফতারকৃতদের পরিচয় এবং তাদের ওপর আরোপিত অভিযোগে দেশটির ঘরোয়া রাজনীতিতে মারাত্মক সঙ্কটের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সৌদি রাজবংশের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব, সাবেক বাদশাহ আবদুল আজিজের ছেলে আহমদ বিন আবদুল আজিজ এবং সাবেক ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নায়েফও রয়েছেন। তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) প্রত্যক্ষ আদেশে। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা এবং বিশ্বাসঘাতকতার যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা অতীতে গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের চেয়ে একেবারে আলাদা।
এ দুই হাইপ্রোফাইল ব্যক্তি ছাড়াও স্থলবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান এবং আহমদ বিন আবদুল আজিজের ছেলে নায়েফ বিন আহমদকে গ্রেফতার করা হয়েছে; মোহাম্মদ বিন নায়েফের ভাই নওয়াওয়াফ এবং ২০ জনেরও বেশি উচ্চপদস্থ প্রিন্স এবং সেনাকর্মকর্তার গ্রেফতারের বিষয়টি একটি নতুন ‘আন্তঃরাজপরিবার শুদ্ধি অভিযান’ বলে মনে হয়।
সৌদি রাজনীতির দিকে গভীরভাবে তাকালে মনে হবে, গ্রেফতারের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো দেশের ঘরোয়া রাজনীতির সাথে এবং বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পরিবর্তনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত।
সালমান-উত্তর যুগের জন্য প্রস্তুতি?
শুক্রবারের গ্রেফতার মূলত বর্তমান বাদশাহ সালমানের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে। তার অবনতিশীল স্বাস্থ্য এবং বয়স নিয়ে উদ্বেগ সময়ের সাথে আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, সালমান-উত্তর সিংহাসনে আরোহণের ‘খেলা’ সম্ভবত শুরু হয়ে গেছে।
সৌদি সংবিধানের ৫ নাম্বার অনুচ্ছেদটি সৌদি শাসনের কাঠামোকে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এতে বলা হয়েছে, বাদশাহ আবদুল আজিজের ছেলেদের সৌদি সিংহাসনের ব্যাপারে প্রাথমিক অধিকার রয়েছে। মোহাম্মদ বিন সালমানকে (এমবিএস) ক্রাউন প্রিন্স নিযুক্ত করা হলেও সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের অধীনে আবদুল আজিজের জীবিত ছেলে আহমদ বিন আবদুল আজিজ আইনিভাবে সিংহাসনের দাবি করতে পারেন বলেই মনে হয়।
সাম্প্রতিক গ্রেফতারের দ্বিতীয় দিকটি হলো, সৌদি অভ্যন্তরীণ নীতিতে আমূল পরিবর্তনে নেতৃত্বদানকারী মোহাম্মদ বিন সালমান রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজপরিবারে যে ভারসাম্য বজায় রাখা হয়েছিল, তা সম্ভবত বিপর্যস্ত করে তুলেছেন আর এটি রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।
সৌদি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে একটি নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও এটি রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভারসাম্যের রাজনীতির ভিত্তিতে তৈরি। এই ভারসাম্য নীতি অনুসারে, সমস্ত ক্ষমতা বাদশাহর হাতে পুরোপুরি কেন্দ্রীভূত নয়। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং সেনাবাহিনী কমান্ড, গভর্নরশিপ, মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী পদে নিযুক্তি প্রভৃতি সৌদি বাদশাহ এবং পরিবারের প্রভাবশালী সদস্যদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে।
সৌদি ব্যবস্থাটিকে মূলত এক সময় ব্যক্তি রাজতন্ত্রের বিপরীতে বংশীয় গণতন্ত্র হিসেবে বর্ণনা করা হতো। রাজবংশের ১০ হাজারেরও বেশি সদস্য সৌদি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রভাবশালী হওয়ার জন্য লড়াই করেন। তারা গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মতো আবদুল আজিজের বিভিন্ন স্ত্রীর সন্তানের ভিত্তিতে ৩৪টি শাখায় বিভক্ত।
এই ব্যবস্থায়, রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক ছাড় এবং জোটের মাধ্যমে সম্ভাব্য সঙ্কটময় পরিস্থিতি সহজেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতো। অন্য দিকে সৌদি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত আলেম-ওলামা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বদাই প্রভাবশালী ছিলেন।
২০১৫ সালে তদানীন্তন বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুর সাথে সাথে সৌদি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এমবিএসের ক্রমবর্ধমান শক্তি এমন একটি প্রক্রিয়া শুরু করে যার, ফলে সৌদি শাসনব্যবস্থার দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বাদ পড়ে যায়। এর একটি হলো, রাজপরিবারের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ আর দ্বিতীয়টি হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ওলামা প্রভাব।
সালমান বিন আবদুল আজিজের কাছ থেকে এমবিএসের হাতের ক্ষমতার ‘মসৃণ পরিবর্তন’ নিশ্চিত করার জন্য, আল ওয়ালিদ বিন তালাল, মুতাব বিন আবদুল্লাহ, মোহাম্মদ বিন নায়েফ এবং তাদের সমর্থিত সিংহাসনের পক্ষে শক্তিশালী- এমন অনেক শক্তিশালী রাজপরিবার সদস্যকে এর আগে গ্রেফতারের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে ভয় দেখানো হয়েছিল। এর ফলে এমবিএসের হাতে ক্ষমতার একচেটিয়াকরণ ঘটে আর দেশে অতীতে রাজপরিবারের যে আন্তঃভারসাম্য ছিল তা আর বজায় থাকেনি।
তাত্ত্বিকভাবে, বর্তমান বাদশাহ সালমানের মৃত্যুর পরে অথবা স্বাস্থ্যগত বা অন্য সমস্যার কারণে তিনি তার দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে পড়লে অতি উচ্চপর্যায়ের রাজপরিবার সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটমেন্ট কাউন্সিল (অ্যালিজিয়েন্স কাউন্সিল) নতুন বাদশাহ নির্বাচন করার কথা। সবাই জানেন, আহমদ বিন আবদুল আজিজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাউন্সিল সদস্য, যিনি নতুন বাদশাহ হিসেবে এমবিএসের নির্বাচনের বিরুদ্ধে ছিলেন। আবার এমবিএসের চালু করা ‘মধ্যপন্থী’ ইসলাম নীতটি সৌদি রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রের সামাজিক বিনির্মাণ উভয় ক্ষেত্রেই ওলামার ভূমিকা ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে।
এখনকার মধ্যপন্থী ইসলাম নীতির কারণে ১৭৪৪ সালে প্রথম সৌদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ বিন সৌদ এবং তৎকালীন ধর্মীয় নেতা মোহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাবের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল, তা ভেঙে পড়েছে। এটি ছিল তিন শতাব্দীর সৌদি রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ উপাদানের ভেঙে পড়া সৌদি উলামায়ে কেরামকে বেশ বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
সৌদি অভ্যন্তরীণ নীতির এই পরিবর্তনগুলো ১৯৬৪ সালে বর্তমান সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আজিজের পরবর্তী বাদশাহ সৌদ বিন আবদুল আজিজের ক্ষেত্রে কী হয়েছিল তা মনে করিয়ে দেয়। ১৯৬০-এর দশক মধ্যপ্রাচ্যের জন্য এমন একটি সময় ছিল যখন মিসরীয় রাষ্ট্রপতি জামাল আব্দুন নাসেরের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক আরব জাতীয়তাবাদ সৌদি আরবসহ রক্ষণশীল আরব রাজতন্ত্রগুলোর জন্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সমাজতন্ত্রের উত্থানের মুখে এ সময় সৌদ বিন আবদুল আজিজের অদক্ষ রাজনীতির কারণে অস্থিরতা দেখা দিলে আলেমদের সমর্থিত রাজপরিবারের সদস্যরা রাজকীয় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফয়সাল বিন আবদুল আজিজকে সৌদের স্থলে প্রতিস্থাপন করেছিলেন। বাদশাহ ফয়সাল ঐতিহ্যগত সৌদি আলেম ও মুসলিম ব্রাদারহুডের সহযোগিতা নিয়ে পরিস্থিতিকে বেশ ভালোভাবে সামাল দেন এবং সৌদি রাজতন্ত্রকে এক শক্ত ভিত্তি প্রদান করেছিলেন।
বাদশাহ ফয়সালের ক্ষমতারোহণ সৌদি রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রথম ঘটনা ছিল, যখন বাদশাহ জীবিত থাকাকালেই রাজপরিবারের অভ্যুত্থানে একজনকে অপসারণ করে তার পরিবর্তে অন্য একজনকে বাদশাহ করা হয়েছিল।
চ্যালেঞ্জের মুখে এমবিএস
২০২০ সালের গোড়ার দিকে বৈশ্বিক অঙ্গনের বেশ কিছু পরিবর্তন এমন একটি প্রক্রিয়া শুরু করে, যা সৌদি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আঞ্চলিক ফ্রন্ট, উভয় ক্ষেত্রেই এমবিএসের হাতকে দুর্বল করে দিয়েছে। এই পরিবর্তনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো করোনাভাইরাস হুমকি, যা চীনের উহান প্রদেশে ডিসেম্বর ২০১৯ সালে আবির্ভূত হয়ে খুব দ্রুত বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাথমিকভাবে এটিকে একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে ধরা হলেও পরে ভাইরাসের সংক্রমণের হার এবং মৃত্যু ও আক্রান্ত সংখ্যা ক্রমবর্ধমান আকার ধারণ করায় তা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য গুরুতর উদ্বেগ নিয়ে এসেছে।
বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং জ্বালানি তেলের চাহিদার প্রাণকেন্দ্র চীনে ভাইরাসটির দ্রুত বিস্তার এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উল্লেখযোগ্য মন্দার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এ কারণে তেলের চাহিদা প্রাচ্যের অর্থনীতিগুলোতে বিশেষত চীনে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
অধিকন্তু, চীনের তেলের চাহিদার এই মন্দা সৌদি আরবকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে, কারণ চীন তার অর্ধেক তেল উপসাগরীয় অঞ্চল থেকেই আমদানি করে থাকে। স্বল্পমেয়াদে তেলের চাহিদা পুনরুদ্ধার হওয়ার আশাও করা যাচ্ছে না।
এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক মন্দা সৌদি আরবের ওপর দু’টি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সৃষ্টি করেছে। তেলের চাহিদা কমে যাওয়ার ফলে এর দাম ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। আর এতে সৌদি আয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭০ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছিল। সেখান থেকে ৬০ শতাংশ দাম কমে মার্চের প্রথম সপ্তাহে ৩০ ডলারে নেমে এসেছে। সৌদি আরবের জাতীয় আয়ের ৯০ শতাংশ তেলের ওপর নির্ভরশীল এবং দেশটির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা কেবল তেলের দাম ৮০ থেকে ৯০ ডলারে থাকলেই নিশ্চিত করা সম্ভব। সঙ্গত কারণেই তেলের দামের এই ধস সৌদি আরবের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে।
সৌদি আরব মারাত্মক বাজেট ঘাটতি নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। তেলের এই হ্রাসকৃত মূল্য আঘাত দেশটির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বিশাল হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে ঘোষিত বাজেট অনুযায়ী, সৌদি আরবের ২০২০ অর্থবছরের মোট বাজেট বরাদ্দ ১.০২ ট্রিলিয়ন রিয়াল (২৭২ বিলিয়ন ডলার)। এটি ২০১৯ অর্থবছরের বাজেটের ১.০৪৮ বিলিয়ন রিয়ালের (২৭৯.৫ বিলিয়ন ডলার) তুলনায় কম। ২০১৯-এর জন্য রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার পরিমাণ ৯১৭ বিলিয়ন রিয়াল (২৪৪.৫ বিলিয়ন ডলার) থাকলেও ২০২০ সালের বাজেটে এটি ৮৩৩ বিলিয়ন রিয়াল (২২২.১ বিলিয়ন ডলার) নির্ধারণ করা হয়েছে। বাস্তবে তা আরো নিচে নেমে যাবে।
পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১২ সালে সৌদি বাজেটের ঘাটতি ছিল ৩৫ বিলিয়ন ডলার, আর ২০২০ সালের জন্য এটি প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫০ বিলিয়ন ডলারে। তেলের দামের সাম্প্রতিক তীব্র অবনয়নে সৌদি বাজেটের ঘাটতি প্রাক্কলিত অঙ্কের চেয়ে আরো বেশি হবে। এটি দেশের অবনতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ।
দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক এই ঘটনাগুলোতে আরো প্রকাশ পেয়েছে, বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে সৌদি আরবের আর আগের নিয়ন্ত্রক প্রভাব থাকছে না। প্রকৃতপক্ষে গত বছর ওপেক থেকে বিতর্কিতভাবে কাতারকে বিদায় করার পর এই সংস্থার জ্বালানিসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সৌদিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে এসেছে।
কিন্তু সম্প্রতি তেলের দাম কমে যাওয়া ঠেকাতে উৎপাদন কমানোর সৌদি প্রস্তাব রাশিয়ার বিরোধিতার কারণে কার্যকর করা যায়নি। অতীতে সৌদি আরব তেল সরবরাহ কঠোরভাবে হ্রাস বৃদ্ধি করে তেলের দামের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখত। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াসহ বড় উৎপাদকরা বাজারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এবং সৌদি আরবের সাম্প্রতিক ব্যয়বহুল বৈদেশিক নীতিতে সে দু’টি দেশই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ায় রাজস্ব হ্রাসের ঝুঁকি নিয়ে তেলের উৎপাদন কমানোর কৌশল বাস্তবায়ন সৌদির জন্য অসম্ভব করে তুলেছে।
এখনকার বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের কাঠামোটি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, সৌদিদের দ্বারা তেলের সম্ভাব্য উৎপাদন হ্রাস যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মতো বৃহত্তম উৎপাদকদের কেবল বাজারে তেলের সরবরাহ বাড়াবে তাই নয়; অধিকন্তু এর পরিণতিতে তারা সৌদিদের জ্বালানির মার্কেট শেয়ারও দখল করে নেবে। গত সপ্তাহান্তে ওপেকের পক্ষ থেকে তেলের উৎপাদন কমানোর দাবি প্রত্যাখ্যানের পরে, রিয়াদ প্রশাসন শেষ পর্যন্ত বিশ্ব তেল বাজারে তার শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীদের ক্ষতি করার নীতি বেছে নিয়ে তেল উৎপাদন আরো বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তৃতীয়ত করোনাভাইরাসের হুমকির কারণে পবিত্র ওমরাহ স্থগিত করা এবং সতর্কতামূলকভাবে মসজিদ আল হারাম ও মসজিদ আন নববী অস্থায়ী বন্ধ হওয়ায় দেশটির বার্ষিক হজ ও ওমরাহ রাজস্ব বাবদ ২৫ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছে, যা অর্থনৈতিক মন্দাকে আরো গভীর করে তুলছে।
হজ ও ওমরাহ পর্যটন দুর্বল হওয়ার আরেকটি পরিণতি হলো, সৌদি আরবের শাসকদের খাদেম আল হারামায়েন আশ শরিফায়েন (দু’টি পবিত্র স্থানের সেবক) হিসেবে বহু বছর ধরে তাদের রাজনৈতিক বৈধতা লাভ এবং ইসলামী বিশ্বে নেতৃত্বের দাবির যে ভিত্তি ছিল, তা দুর্বল হয়ে পড়া। এটি দেশটির অভ্যন্তরে শাসকদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে। একই সাথে ইসলামী বিশ্বে সৌদিদের সুনামও ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
এমবিএসের উদ্যোগে শুরু হওয়া ইয়েমেন যুদ্ধ, সাংবাদিক খাশোগি হত্যার মাধ্যমে সৌদিদের আন্তর্জাতিক সুনামের ক্ষতি, বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে সৃষ্ট বাধায় সৌদি অর্থনীতির পশ্চাৎপদতা, মধ্যপন্থী ইসলামের নামে সৌদি আলেমদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, বিতর্কিত বিনোদন খাতের পুনরুজ্জীবন এবং রাজপরিবারের শক্তিশালী সদস্যদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান সৌদি আরবকে এক গভীর খাদে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে।
তুর্কি অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. নেমমেতিন আকারের বিশ্লেষণটি এ ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে, এমবিএস প্রশাসনের ব্যর্থতা সৃষ্ট ক্ষোভ দেশের রাজনীতিকে ভিন্নমুখী করার কাজ সহজ করে তুলতে পারে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে দেখা যায়, এমবিএস এবং তার প্রশাসনবিরোধী ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ তিনি গভীরভাবে অনুভব করছেন। রাজপরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আজিজের ছেলে আহমদ বিন আবদুল আজিজকে গ্রেফতার করার ঘটনায় সেটিই মনে হয়। আর এটিও মনে হয় যে, তিনি যে পথে এর আগে এগিয়েছেন সেই জবরদস্তির পথে অগ্রসর হওয়া ছাড়া তার সামনে বিকল্প নেই। এ বিষয়টি অন্য কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব।
বিন সালমান লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেন?
বিন সালমান জানতেন, প্রিন্স আহমদ লন্ডনে নিজের বাড়ি ছাড়ার আগে এমআই এবং সিআইএর কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছিলেন, দেশে ফিরে যাওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করা হবে না। এ বিষয়টি অমান্য করার ক্ষেত্রে এমবিএস অর্থাৎ সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার জামাতা জ্যারেড কুশনারের ওপর ভরসা করছেন। বিন সালমানের আরেক ভরসাস্থল ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়েছেন। আমেরিকান ডিপ স্টেটের পূর্বাভাস অনুযায়ী, নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে ফিরে আসছেন না।
যদি এমন হয়, ট্রাম্প এবং কুশনার দু’জনেই নভেম্বরের পরে হোয়াইট হাউজে আর না থাকেন, তাহলে কী হবে? ডেমোক্র্যাট সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরাইলের সমর্থনপুষ্ট, ঘোষিত জায়নবাদী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে বিন সালমানের ব্যাপারে ভিন্ন ধারণা থাকা জো বাইডেনের কাছ থেকে কী আশা করবেন এমবিএস?
মধ্যপ্রাচ্যে বাইডেন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বহুলপ্রতীক্ষিত পরিবর্তন করেই ফেলবেন, তা কেউ প্রত্যাশা করছেন না। তবে এর অর্থ এই নয় যে, কোনো কিছুই পরিবর্তিত হবে না। ট্রাম্পের বিদেশী মিত্রদের ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক উন্মোচনের বিষয়ে বাইডেনের ব্যক্তিগত আগ্রহ থাকবে। আর তাদের মধ্যে মোহাম্মদ বিন সালমান হতে পারেন অন্যতম। আমেরিকা সৌদি রাজতন্ত্রের পেছনে থাকতে পারে; তবে নতুন বাদশাহ হিসেবে দেশে-বিদেশে স্বল্প গ্রহণযোগ্য বিন সালমানকে সমর্থন না-ও করতে পারে।
আর সে ক্ষেত্রে সৌদি আরবের মোহাম্মদ বিন নায়েফের মতো সিআইএর পরিচিত মিত্র আবার সামনে চলে আসতে পারেন। এমবিএস এই ঝুঁকিটিকে গ্রেফতার বা বিচারের মাধ্যমে মুছে দিতে চাইছেন বলে মনে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অস্থির রাজনৈতিক আবহাওয়ায় বিন সালমানের জন্য এটি এক বিশাল জুয়ার মতো হয়ে দাঁড়াতে পারে। ক্রাউন প্রিন্স এমবিএসকে সৌদি আরবের বাদশাহ হিসেবে ট্রাম্পের মতো করে অন্য কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট চাইবেন না- সেটিই স্বাভাবিক হতে পারে। আর যেখানে রাশিয়া, চীন, ইরান এবং তুরস্কের বিপরীতে মার্কিন সেনা আশ্রয়ে সৌদি রাজতন্ত্র অনেকখানি টিকে থাকছে, সেখানে আমেরিকার হিসাব-নিকাশের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। ডেভিড হার্স্টের মতে, স্বল্প-দীর্ঘ কেরিয়ারে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্য বর্তমান কার্যক্রম সবচেয়ে বড় জুয়া খেলা হয়ে যাচ্ছে। আসল সমস্যাটি হলো, বিন সালমান এবং তার পরামর্শদাতারা বোধহয় নিজের ভুলটি অনুধাবন করতে খুব ভুল করে ফেলছেন।
এই ভুলের পরিণতি কত দূর গড়ায়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।